শোকাহত: (বাঁ দিক থেকে) মালা হেলা, মধু ও সন্দীপ হেলা, সুমিত্রা হেলা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চার বছর কেটে গিয়ে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। এখনও সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় ওঁদের। এত বছর পরেও বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় কারও মৃত্যু বা আহত হওয়ার খবর শুনলে ওঁদের মনে হয়, এর কি শেষ নেই? আবার কোন মায়ের কোল খালি হয়ে গেল!
কলকাতা বিমানবন্দরের দু’নম্বর গেট সংলগ্ন আমবাগান এলাকার ভাড়া বাড়িতে বসে প্রায় পাঁচ বছর আগের বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করতে চাইছিলেন না দুই মা মধু হেলা ও মালা হেলা। কান্নাভেজা গলায় দু’জনেই বলছিলেন, ‘‘বিবেকানন্দ রোডে লরির ধাক্কায় দু’জনের মৃত্যুর খবর যখন টিভিতে দেখাচ্ছিল, টিভি বন্ধ করে দিয়েছি। বার বার মনে হয়েছে, আমাদের ছেলেদের মতো আরও কত প্রাণ এ ভাবে যাবে?’’
২০১৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মাঠকল এলাকায় বেপরোয়া লরির ধাক্কায় মারা যায় মালার তিন ছেলে আদিত্য হেলা (১৭), অনুরাগ হেলা (১৫) এবং অর্জুন হেলা (৯)। মৃত্যু হয় মালার ননদ মধুর ছেলে যুগ হেলারও (৫)। মালা বলেন, ‘‘তিন ছেলের অকালমৃত্যুতে আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এই ধরনের খবর শুনলে শরীর খারাপ লাগে। রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না।’’
আরও পড়ুন: ‘ভয়েই’ বেপরোয়া দৌড় লরির, বলছেন চালকেরা
আরও পড়ুন: ‘আমার গোপালকে কেড়েছে বাজি, এর বিক্রি নিষিদ্ধ হোক’
ওই দিন ছিল সরস্বতী পুজো। ঠাকুরমা সুমিত্রা হেলা, মা-বাবা মধু ও সন্দীপের সঙ্গে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল যুগ, আদিত্য, অনুরাগ ও অর্জুন। বাস ধরার জন্য তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন মাঠকল স্টপে। আচমকা একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই বাসস্টপে ধাক্কা মারে। লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে যায় আদিত্য, অনুরাগ, অর্জুন ও যুগ। ঘটনাস্থলেই মারা যায় দু’জন। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরও দু’জনের। মধু বলেন, ‘‘ওরা চার জন বাসস্টপের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা ছিলাম একটু ভিতরে। চোখের সামনে ওদের লরির চাকার নীচে চলে যেতে দেখেছি। ঘটনার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, শুনলাম সব শেষ।’’
ওই দুর্ঘটনার পরে মধুর সন্তান হয়েছে। কিন্তু মালার আর সন্তান হয়নি। এখন মধুর বাচ্চাদের নিয়েই দিন কাটে তাঁর। আমবাগানের বাড়িতে দুই পুত্রবধূকে গত চার বছর আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সুমিত্রা। কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসে সামান্য কাজ করেন তিনি। সুমিত্রা বলেন, ‘‘মালার স্বামী অর্থাৎ আমার বড় ছেলে মুন্না রিকশা চালায়। সেই সঙ্গে দমদম পুরসভা থেকে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে ওকে অস্থায়ী কাজ দিয়েছে। তাতে কি সংসার চলে? আর মধুর স্বামী, ছোট ছেলে সন্দীপকে বরাহনগর পুরসভা দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে অস্থায়ী কাজ দিয়েছিল। কিন্তু পরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত দু’বছর ছেলেটার কাজ নেই। ওই দুর্ঘটনার পরে নানা আশ্বাস মিলেছিল। তার পরে আর কিছুই হয়নি।’’
মালা বলেন, ‘‘বেঁচে থাকলে আজ বড় ছেলে আদিত্যর বয়স হত ২১। পড়াশোনায় ভাল ছিল ও। কোনও কাজে হয়তো ঢুকে যেত।’’ তিনি জানান, আদিত্য ও তার তিন ভাই এয়ারপোর্ট স্কুলে পড়ত। পড়াশোনার সঙ্গে ভাল ছবিও আঁকত আদিত্য।
সে দিনের দুর্ঘটনার পরে শহরের পথে বেপরোয়া গাড়ির দাপট কি কিছু কমেছে? প্রশ্ন দুই মায়ের। মধু বলেন, ‘‘মাঝেমধ্যেই তো এমন দুর্ঘটনার খবর শুনি। কেন পুলিশ আরও কঠোর হয় না? কেন এমন দুর্ঘটনা ঘটলে চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে না?’’মালা জানান, সে দিনের পর থেকে আর কোনও দিন বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াত করেননি তাঁরা। ওই রাস্তা তাঁদের কাছে সারা জীবনের জন্য দুঃস্বপ্নের সরণি হয়ে রয়েছে।