রাজভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের দৃশ্য। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বুধবার। বিকেল ৫টা ২৮ মিনিট। এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে নতুন বিবৃতি পোস্ট করল রাজভবন। বলা হল, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য যে সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ দেখতে চেয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে দেখাবে রাজভবন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পুলিশ ছাড়া যে কেউ চাইলেই সেই ফুটেজ দেখতে পারবেন। খবরটা পেয়েই তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। রাজভবনে গিয়ে ওই ফুটেজ আমাকে দেখতেই হবে। তাই বিবৃতিতে দেওয়া নম্বরে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি।
ফোনে রাজভবনের তরফে আমার নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যে রাজভবনে পৌঁছতে পারব কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। রাজভবনের বিবৃতিতে লেখা ছিল, যাঁরা ফোন বা ইমেলের মাধ্যমে সিসিটিভি ফুটেজ দেখার জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে চাইবেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম ১০০ জন ফুটেজ দেখার সুযোগ পাবেন। আমি সেই সুযোগ পাব কি না, আমার ফোন ১০০ জনের মধ্যেই কি না, তা যদিও জানানো হল না। পরেও রাজভবন থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি আমাকে। ফলে আদৌ ফুটেজ দেখার সুযোগ আমি পাব কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি সকাল পর্যন্ত।
নিশ্চয়তা না পেয়ে সকালে সরাসরি পৌঁছে গেলাম রাজভবনের দুয়ারে। সময়ের অনেক আগেই আমি পৌঁছেছিলাম। ওখানে গিয়ে দেখি, আমার মতো আরও কয়েক জন দাঁড়িয়ে আছেন। সকলেই ফুটেজ দেখতে চান। তবে যাঁরা এসেছিলেন, প্রায় সকলেই সাংবাদিক। পেশার তাগিদেই রাজভবনের ফুটেজ দেখতে এসেছেন সকলে। কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পর রাজভবনের এক কর্মী এসে আমাদের আরও কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। জানালেন, ভিতর থেকে তালিকা ধরে নাম পড়া হবে। তালিকায় নাম থাকলে আমরা ঢুকতে পারব।
তালিকা অবশ্য এল না। আরও কিছু ক্ষণ পর রাজভবনের এক কর্মী এসে জানালেন, যাঁরা সাংবাদিক, তাঁরা নাম এবং পরিচয় লিখে ভিতরে ঢুকে যেতে পারবেন। আমরাও তা-ই করলাম। এর মাঝে রাজভবনের দরজার বাইরে পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোককে দেখেছিলাম। তিনি কোনও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি নন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কোথা থেকে এসেছেন?’’ উত্তর এল, ‘‘কলকাতা থেকে।’’ বুঝলাম, নিজের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য তিনি দিতে রাজি নন। রাজভবনের কর্মীদের তিনি জানান, সকালে খবরের কাগজে ফুটেজ দেখানোর বিষয়টি জানতে পেরেই তা দেখতে চেয়ে মেল করেছিলেন। তাঁকেও রাজভবন থেকে কিছু জানানো হয়নি। ফলে তিনি চলে এসেছেন। কিছু ক্ষণ কথা বলার পর তাঁকেও ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়।
১০০ জনের আসন ছিল। তবে বৃহস্পতিবার রাজভবনে অত লোক আসেননি। প্রায় ৩০ জন ফুটেজ দেখতে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুই থেকে তিন জন বাদে বাকিরা সকলেই সাংবাদিক। এক জন অধ্যাপক এসেছিলেন ফুটেজ দেখতে। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বলেই জানান। তাঁর দাবি, সেই কারণেই এসেছেন ফুটেজ দেখতে।
আমরা সকলে রাজভবনের মার্বেল হলে গিয়ে বসেছিলাম। সেখানেই তৈরি ছিল প্রজেক্টর। আরও এক দফা নামধাম লেখার পর শুরু হল অপেক্ষা। সাড়ে ১১টার সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল। ১২টা ১০ মিনিট নাগাদ শুরু হল সেই বহু প্রতীক্ষিত ফুটেজ দর্শন। এর পর ১ ঘণ্টা ১৯ মিনিটের ফুটেজ দেখলাম আমরা সকলে। রাজভবনের বাইরের দরজায় বসানো দু’টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখানো হয়। তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায় অভিযোগকারিণী মহিলাকে। ফুটেজে তাঁকে রাজভবনের দিক থেকে পুলিশের আউটপোস্টের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখা যায়। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে যান ওই মহিলা।
ওই মহিলা অভিযোগপত্রে জানিয়েছিলেন, রাজভবনের কনফারেন্স রুমে ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাজভবন কর্তৃপক্ষ ভিতরের কোনও সিসিটিভি ফুটেজ দেখাননি। যদিও রাজভবনের ভিতরে নীচের তলায় এই মুহূর্তে মোট ৪০টি সক্রিয় সিসি ক্যামেরা রয়েছে। উপরের তলায় যেখানে রাজ্যপাল থাকেন, সেখানে কোনও ক্যামেরা নেই। ভিতরের কোনও ক্যামেরার ফুটেজই দেখানো হয়নি। যা দেখানো হল, প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে সে সব দেখে, চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
রাজভবন সূত্রে জানতে পেরেছি, বুধবার বিকেল থেকে এই ফুটেজ দেখার জন্য অন্তত ৭৫টি ফোন এসেছিল। এ ছাড়া, ইমেলেও আবেদন জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। তবে শেষ পর্যন্ত আগ্রহীদের অর্ধেকও এসে পৌঁছননি। কারা ফোন করেও এলেন না, কারও আবেদন রাজভবন নাকচ করে দিল কি না, দিনের শেষে জানা গেল না কিছুই। সে দিন রাজভবনের ভিতরে কী ঘটেছিল, তা নিয়েও সম্পূর্ণ ধোঁয়াশাই থেকে গেল।