শহর কলকাতার বহু পুরনো পাড়ায় প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে বাঙালির সংখ্যা। এই বদল হল কবে, কী ভাবে?
নতুন বছরের শুরুতেই সাতটি ক্লাবের সভাপতি পদে রদবদল হয়েছে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে। যাঁদের পদ ছাড়তে হয়েছে, প্রত্যেকেই বাঙালি। তেলিপাড়া আর গ্যালিফ স্ট্রিটের একটি করে ক্লাব ছাড়া সব ক’টিতেই নতুন যাঁরা পদাভিষিক্ত হয়েছেন, সকলেই অ-বাংলাভাষী! পদ-হারা এক ব্যক্তি বললেন, “সামনেই বিধানসভা ভোট। ক্লাবের ভোট দিয়ে কী হবে! যাঁরা পাড়ায় টাকা জোগাতে পারবেন, তাঁরাই ক্লাব-সভাপতি হবেন। পাড়ার শুভানুধ্যায়ী বা পৃষ্ঠপোষক কম টাকাওয়ালা লোক হলে চলে! বাঙালির অত টাকা কোথায়?”
এই টাকার জোরেই পাড়ায় পাড়ায় অ-বাংলাভাষীদের দাপট বলে জানাচ্ছেন অনেকেই। নেতা থেকে পুলিশ— কেউই তাঁদের ঘাঁটান না। ‘পাড়ার গৌরী সেন’ হয়ে তাঁরা ক্লাবের কর্তা থেকে পুজোর মূল উদ্যোক্তা হয়ে যান। জনসেবামূলক কাজ না করলেও তাঁদের অফিসে ঝোলে ‘বিশিষ্ট সমাজসেবী’ লেখা বোর্ড। তাঁরাই পাড়ার জলসার শিল্পী ঠিক করেন। তাঁরাই আবার শব্দবিধি উড়িয়ে রাত ৩টে-৪টে পর্যন্ত বক্স বাজানোর প্রশাসনিক অনুমতি পাইয়ে দেন।
মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ লাগোয়া এমনই একটি পাড়ার বাসিন্দার দাবি, “এখানেও ক্লাবের মাথা টাকার জোরে জায়গা পাওয়া এক অ-বাংলাভাষী। তিনি পাড়ার দুর্গাপুজোর প্রতিমা থেকে আলো— সবেরই টাকা দেন। বদলে পাড়াতেই চলে তাঁর বেআইনি ব্যাটারির ব্যবসা। পাড়ার লোক থেকে পুলিশ, চুপ সকলেই।”
যদুবাবুর বাজার সংলগ্ন এক বহুতলের বাসিন্দা সুজন হালদার বললেন, “এখানকার ক্লাব বা কমিউনিটি আড্ডার বহু জায়গাই বহু দিন ধরে অ-বাংলাভাষীদের দখলে। এক সময়ে তাঁদের টাকায় জনসংযোগ করবেন বলে ভেবেছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। একটা সময় পর্যন্ত তা হয়েওছে। পরে সবটাই হাতছাড়া। এখন ভবানীপুরে বাঙালি পাওয়াই মুশকিল।” যাদবপুরের শ্রীকলোনির বাসিন্দা, স্কুলশিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা ঘোষের বক্তব্য, “ভোটের আগে বহু পাড়াতেই টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা জোগান যাঁরা, তাঁদের রাস্তা আটকে ব্যবসা করার বা গৃহস্থের বাড়ির গেট আটকে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা মিলছে না।”
গোলপার্কের পূর্ণ দাস রোডের বাসিন্দা রাহুল ঝাঁয়ের অবশ্য দাবি, “ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবাও করি। তাই পাড়ার লোকে মানেন। সকলে জানেন, সমস্যায় পড়লে আমার কাছে সাহায্য মিলবে।” সূর্য সেন স্ট্রিটের সুনীল চৌরাশিয়ার আবার স্পষ্ট যুক্তি, “কুড়ি বছর কলকাতায় রয়েছি। ব্যবসা করার জন্য সকলকে খুশি খুশি রাখি বলেই ক্লাবের সভাপতি করেছে আমাকে। পুজোয় যখন স্পনসর ছিল না, আমিই তো সব দেখে দিয়েছি!” একই সুর মুদিয়ালির পুজোকর্তা মনোজ সাউয়ের গলাতেও। তাঁর মন্তব্য, “আমাদের শুধু টাকা নয়, মনও আছে। পাড়ার ভালর জন্য যা করি, বাঙালি বন্ধুরাও জানেন। পুজো থেকে সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান— সবেতে তাই আমরাই ভরসা।”
জনসংযোগ গবেষক সুধীর বসু মনে করেন, এই ‘ভরসা’ তৈরি করা জনসংযোগেরই অঙ্গ। এর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে পাড়ায় বা সমাজে প্রতিপত্তি গড়ার চেষ্টা। তাঁর কথায়, “প্রতিপত্তি বজায় রেখে কিছু একটা হাসিল করার ইচ্ছে সকলের থাকে। কেউ তা সাহায্যের নামে করেন, কেউ কঠোর শাসন জারি করে। বেশিটাই হয় সাহায্যের নামে আনুগত্য কেনার চেষ্টা। যাঁর যত টাকা, তাঁর সাহায্যের হাত তত বড়।”
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, “ক্লাবের সভাপতি বা পাড়ার পৃষ্ঠপোষক পয়সাওয়ালা না হলে হয় নাকি! ‘পরশপাথর’ ছবিতেও পরেশচন্দ্র দত্ত হঠাৎ পাওয়া টাকার কিছুটা পাড়ার সমিতিতে দান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওরাই তো আমাকে দেখবে’। অর্থাৎ, টাকার বদলে কিছু একটা পেতে চাইছেন। যাঁরা টাকায় বড় হন, তাঁরা পরোপকারের বদলে কিছু পেতে চান। এখন পাড়ায় পাড়ায় অবাঙালিই যে টাকায় বড়, তা আর বলে দিতে হয় না।”
এমনই ইচ্ছের উদাহরণ মিলেছিল বর্ষবরণের জলসায়। মঞ্চে লোকসঙ্গীত গায়িকা। এক ব্যক্তি ঘোষককে নাগাড়ে বলছেন, “একটা হিন্দি গাইতে বলো। দাদা শুনবেন বলে বসে আছেন। ভয় করছে, রেগে চলে না যান! পরের বার তা হলে আর অনুষ্ঠানই হবে না!” ঘোষক বোঝাতে পারছিলেন না যে, এই শিল্পী হিন্দি গাইবেন না। শেষে ঘোষককে বলা হল, “এঁকে নামিয়ে হিন্দি তোলো, জলদি!”