ফুটপাথে ফের সূর্যোদয়, এ বার হকারদের

ফুটপাথে পা রাখার জো নেই। সিঁথির বাস ধরতে শনি-দুপুরে অরবিন্দ সরণির মুখটায় বড় রাস্তায় নেমেই দাঁড়িয়েছিলেন প্রৌঢ়। এখনও তাঁর চোখে লেগে দু’দশক আগের সেই দৃশ্য। “এখানটায় দাঁড়িয়েই বুঝলেন, সটান পাঁচ মাথার মোড়ের নেতাজিকে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখেছিলাম সে বার!”

Advertisement

সাবেরী প্রামাণিক ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০৩:১২
Share:

অপারেশন সানশাইনের পরে হাতিবাগান।

ফুটপাথে পা রাখার জো নেই। সিঁথির বাস ধরতে শনি-দুপুরে অরবিন্দ সরণির মুখটায় বড় রাস্তায় নেমেই দাঁড়িয়েছিলেন প্রৌঢ়। এখনও তাঁর চোখে লেগে দু’দশক আগের সেই দৃশ্য। “এখানটায় দাঁড়িয়েই বুঝলেন, সটান পাঁচ মাথার মোড়ের নেতাজিকে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখেছিলাম সে বার!”

Advertisement

দক্ষিণে বাসন্তীদেবী গার্লস কলেজের সামনের ‘কেয়ার অব ফুটপাথ’ শাড়ি-কারবারিও সে সব দিন মনে রেখে দিয়েছেন। ‘অপারেশন সানশাইন’-এর পরে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ওই তল্লাটে দাঁড়িয়েই অবাধ দৃষ্টির সামনে ফুটে উঠত ‘গড়িয়াহাটার মোড়’।

সেটা ছিল ১৯৯৬ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার ‘স্বপ্নের কলকাতা’ অন্য কথা বলছে। অন্তত ‘দখলদারমুক্ত ফুটপাথ’-এর স্বপ্নটা এ শহর যে ছেঁটে ফেলেছে বা ফেলতে বাধ্য হয়েছে, তা এ বার পরিষ্কার। হকারদের লাইসেন্স দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ফুটপাথে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করতে হকারমহলে ফুরফুরে আত্মবিশ্বাস। হাতিবাগানের শপিংমলের সামনে ফুটপাথের জুতো-কারবারি ঠোঁট উল্টে হাসছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় খুশি হলেও তাচ্ছিল্যের ভাবটা বহাল রাখলেন। বললেন, “লাইসেন্স দেবে বলেছে, ঠিক আছে! না দিলেই বা কী হতো!”

Advertisement

এখন হাতিবাগান।

বাম-জমানায় হকার সরিয়ে ‘সূর্যোদয়’ ঘটানোর স্পর্ধা ব্যর্থ হওয়ার পরে বাস্তবিক শহরময় হকার-সাম্রাজ্য ঝাড়ে-বংশে বেড়েছে। গড়িয়াহাট ইন্দিরা হকার্স ইউনিয়ন তথা হকার সংগ্রাম কমিটির উঁচুতলার নেতা অভিজিৎ সাহার হিসেবেই সেটা স্পষ্ট। অভিজিৎবাবুই জানালেন, ‘অপারেশন সানশাইন’-এর কলকাতায় বরং অনেক কম হকার ছিল। গড়িয়াহাটে তখন হাজার দেড়েক হকার থাকলে, এখন তা অন্তত ২২০০ জন। ‘জাতীয় হকারনীতি’ ঠিক হয়েছে ‘সানশাইন’ পর্বের পরে। সে সব নেহাত কাগজে-কলমে। নিয়ম মাফিক, ফুটপাথের দুই তৃতীয়াংশ ছেড়ে ব্যবসা করার কড়াকড়ি অনেকেই আমল দেন না। ফুটপাথের প্লাস্টিকের ‘ছাদ’ নিয়ে ট্যাঁ-ফোও সহ্য করা হয় না। “প্লাস্টিক খারাপ জিনিস, দেখতেও খারাপ লাগে সব সত্যি! কিন্তু প্লাস্টিক ছাড়া ফুটের মাল কী করে বাঁচাব বলুন দেখি?” প্রশ্ন অভিজিৎবাবুর।

অপারেশন সানশাইনের পরে গড়িয়াহাট।

ফলে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে গড়িয়াহাট পর্যন্ত দু’ধারের ফুটপাথের একাংশ দিনে-দুপুরেই প্রায়ান্ধকার জঙ্গলে পরিণত। প্লাস্টিক ছাওয়া পথে পরপর চুড়ি-হার-দুল-ক্লিপের পসরা সাজানো। কিংবা মাথার উপরে ঝুলন্ত পোশাক-ব্যাগ-বেল্ট-অন্তর্বাসের ঝুরি নামছে। টুলের সিংহাসনে বসে খোশমেজাজে কারবার চালাচ্ছেন ‘পথের বাদশা’রা।

উত্তর কলকাতার সরু রোগাটে রাস্তায় দখলদারের উপদ্রবে অবস্থা আরও সঙ্গীন। সন্ধ্যায় উপচে ওঠা ফুটপাথের সৌজন্যে রাজপথেও ভরপুর জটলা। ফলে হাতিবাগানে যানজটের ঝক্কি নিত্য-নৈমিত্তিক। সপ্তাহান্তে ভরদুপুরেই ফুটপাথে জনতার ব্যূহ ভেদ করে এগোতে নাকাল হতে হল। টাউন স্কুলের সামনে ধাক্কাধাক্কিতে হোঁচট খেতে গিয়ে সামলে নিলেন জনৈক মধ্যবসয়িনী। সঙ্গে সঙ্গে হকারের তিরিক্ষে চোটপাট। চিলতে ফুটপাথের দু’দিক জুড়েই নানা কিসিমের পসরা। এগোতে গেলে ঝুলন্ত ব্যাগ-পোশাক ইত্যাদিতে মাথায় ঠোক্কর লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে হকার-ভায়াদের বকুনি, ‘দেখতে পান না। সাবধানে হাঁটুন!’

গড়িয়াহাটের অভিজিৎবাবু অবশ্য অভয় দিচ্ছেন, হকারের ডালার বাইরে বেরিয়ে থাকা জিনিসপত্র শীঘ্রই ঢুকিয়ে ফেলা হবে।

এখন গড়িয়াহাট।

নিউ মার্কেটে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। হকারের ভিড়ে হাতিবাগান-গড়িয়াহাটেও দোকানের মুখ দেখা দুষ্কর। বড় দোকানের বিক্রেতারাও কিন্তু তাঁদের মতো করে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। গড়িয়াহাট মোড়ের দীর্ঘদিনের পুরনো প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানে তেমনই পাল্টা দাওয়াইয়ের কথা শোনা গেল। দোকানের সাইনবোর্ডের জন্য বছরে ২৪ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার নিয়ম পুর-কর্তৃপক্ষকে। দোকান-মালিক সাফ বলছেন, “কয়েক বছর হল, সাইনবোর্ডের জন্য পুরসভাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি! কেন দেব? হকারের ভিড়ে কিছু দেখাই যায় না। ওরা এসে বরং সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যান। তাতেই শান্তি!”

‘অপারেশন সানশাইন’-এর খোলামেলা ফুটপাথের কলকাতাটা অতএব ঘোর মিথ্যে! শহরবাসীর বেশির ভাগই এখন সে দুরাশা ভুলতে বসেছেন।

ছবিগুলি তুলেছেন দেবস্মিতা ভট্টাচার্য, শুভাশিস ভট্টাচার্য এবং ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement