ইস্কনের রথের মেলায় রাশিয়া-ইউক্রেনের দুই ভক্তের কীর্তন। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
‘ভামশিপ্রিয়া দেভি দাসী!’
নীল শাড়ির দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গিনীর নামটা খটোমটো লাগলে আঙুলের মুদ্রায় ‘বাঁশি’ বোঝালেন পাশে বসা ধুতি-সজ্জিত শ্বেতাঙ্গ যুবক। তিনি ‘ইষ্টদেব নারদ দাস’। ইউক্রেনের কিভের মেয়ে বংশীপ্রিয়া ওরফে ভিক্তোরিয়া বেরেজন্যাকোভা আগে পিয়ানো বাজাতেন। তিনি হারমোনিয়াম ধরতেই তাঁর সঙ্গে করতাল বাজিয়ে সু-কণ্ঠে ‘হ্যারে কৃষ্ণা, হ্যারে কৃষ্ণা’ ধরলেন নারদ ওরফে ইলিয়া স্তারশিনোভ। রুশ দেশের সাইবেরিয়ার তমস্ক শহরের ছেলে নারদ। ময়দানে ব্রিগেডের মাঠে ইস্কনের রথের মেলা রুশ, ইউক্রেনের যুগলবন্দিতে জমে উঠল।
কিভ শহরের বরফে মোড়া রণাঙ্গনে জপমালা হাতে বন্দুকধারী ইউক্রেনীয় সৈনিকের ভিডিয়ো অনেকেই দেখেছেন। ‘হরে কৃষ্ণ’র মহামন্ত্র বিড়বিড়িয়ে যিনি বলছিলেন, “আত্মার বিনাশ নেই জেনেই দেশের কাজ করতে যুদ্ধে নেমেছি!” কলকাতার রথের মেলায় কীর্তনের ফাঁকে রুশ ভাষার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে ইউক্রেনের ভিক্তোরিয়া (বংশীপ্রিয়া) বললেন, “তিন বছর হয়ে গেল কিভে মা, বাবাকে দেখিনি। ভিডিয়ো কলই ভরসা! বোমার খবরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি।” তাঁর ভাষা ইংরেজিতে তর্জমা করে বোঝাচ্ছিলেন নারদ ওরফে ইলিয়াই।
রাশিয়ায় দেড়শোর বেশি ইস্কন মন্দির থাকলে ইউক্রেনে রয়েছে অন্তত ৪৫টি। ইস্কন, কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমণ দাস মস্কোয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েই ‘হরে কৃষ্ণ’র দলে দীক্ষিত হন। রাশিয়া, ইউক্রেনের ভক্তদের সঙ্গে রুশ ভাষায় আলাপচারিতায় তিনি স্বচ্ছন্দ। রাধারমণ বলছিলেন, “ইউক্রেনের মন্দিরগুলি কিন্তু বিপন্ন মানুষের জন্য খুলে দিয়েছি। দুর্গতদের নিয়মিত খাবার বিলি করা হচ্ছে।” লিভিভ শহরে রুশ বোমাবর্ষণে দু’জন স্বেচ্ছাসেবী ভক্তের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল। কলকাতার রথের মেলায় কিন্তু রুশ ও ইউক্রেনীয় ভক্তেরাই পুরোভাগে। ভাষাগত মিলের জন্য যুযুধান দুই পড়শি দেশের ভক্তেরাই পরস্পরের সব থেকে কাছের।
৩৯ বছরের রুশ যুবক ইলিয়া বলছিলেন, “যুদ্ধ, প্রাণহানি মানা যায় না!” মায়াপুরে সপরিবার থেকে অনলাইনে কাজ করেন ইলিয়া। ইস্কনের স্কুলে পড়ে তাঁর ছেলে। পঞ্চাশোত্তীর্ণা ভিক্তোরিয়ার স্বামী, ২২ এবং ১৬ বছরের দুই ছেলেও মায়াপুরবাসী। ভিক্তোরিয়ার স্বামীও অনলাইনে কাজ করতেন। কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য তা থমকে গিয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইগর ওরফে যোগেশ্বর দাস বা ইউক্রেনের ওডেসার মেয়ে নাতালিয়া ও তাঁর পাঁচ বছরের দস্যি ছেলের সঙ্গেও রথের মেলার আসরেই দেখা হল। নাতালিয়া এখন মন্ত্রদীক্ষার অপেক্ষায়। এর পরে তাঁর একটি হিন্দু নাম হবে। কলকাতার গুমোট সন্ধ্যাতেও ক্লান্তি নেই এই মাতাজি, প্রভুজিদের (ইস্কনে নারী, পুরুষকে সম্বোধনের এটাই রীতি)! ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’-এর তালে তালে পিছনে দাঁড়িয়ে জনৈক ইজ়রায়েলি ভক্ত ভেরোনিকার সঙ্গে সমানে নাচছিলেন নাতালিয়া। নাতালিয়ার স্বামী অনলাইনে লিথুয়ানিয়ায় কাজ করেন।
রাধারমণ বলছিলেন, “ইউক্রেনের ভক্তেরা অনেকেই মায়াপুরে, বৃন্দাবনে সঙ্কটে আছেন! টাকাপয়সা ফুরিয়েছে, পকেট প্রায় খালি।” যুদ্ধ-বিরোধী রুশ যুবক ইলিয়া বললেন, “রাজনীতি বুঝি না! কিন্তু ইউক্রেনের ভক্তদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি সাধ্যমতো!” তাঁর পাশে বসেই ভিক্তোরিয়াও বলেন, “কিসের শত্রু, মিত্র! সকলেই আত্মা! শ্রীকৃষ্ণ যা দেবেন, তাতেই খুশি!”
রথের মেলার মণ্ডপে রথ থেকে নামা জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার উপস্থিতিতে এখন নব বৃন্দাবনের ভাব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শত্রুতার শব্দগুলির এখানে প্রবেশাধিকার নেই।