বাস্তব: হাওড়া স্টেশন চত্বরে কাজ চলছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর। ছবি: রণজিৎ নন্দী
১৯২১ সালেই এ শহরে প্রথম পাতাল রেলের কথা ভাবা হয়েছিল! তাও আবার এখনকার নির্মীয়মাণ ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ধাঁচে!
রেলের ইতিহাস বলছে, গঙ্গার পশ্চিম দিকে কলকাতার যমজ শহরের সঙ্গে পূর্ব প্রান্তের ইষ্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের যোগাযোগের জন্য পাতাল রেলের পরিকল্পনার ভার পড়েছিল লন্ডন টিউব রেলের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার হার্লি হিউ ডালরিম্পল হে-র উপরে। শহরের মাটির চরিত্র বিচার করে কী ভাবে নদীর নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ হবে, সেই পরিকল্পনা করেছিলেন ওই প্রযুক্তবিদ। সেই সময়ে প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ৩৫ লক্ষ ২৬ হাজার ১৫৪ পাউন্ড। সাড়ে চার বছরেই প্রকল্প শেষ করা যাবে বলে জানান তিনি। ‘ক্যালকাটা কমিউনেকশন কমিটি’র এই রিপোর্টের মান্যতা দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের রেল দফতর।
তবে প্রাদেশিক সরকারকেই প্রকল্পের খরচ বহন করতে বলা হয়েছিল। টাকার অভাবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে আসে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার। ডালরিম্পলের দূরদর্শিতা যে তারিফ করার মতো, তা মানেন বর্তমান কলকাতা মেট্রোর অনেক কর্তাই।
ঔপনিবেশিক কলকাতার অনেক কিছুর মতো পাতাল রেলের অনুপ্রেরণাও লন্ডন থেকে। তার-ও আটান্ন বছর আগে ১৮৬৩ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট মিনিস্টারের প্যাডিংটন থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনের ফ্যারিংডনের মধ্যে ছুটেছিল পৃথিবীর প্রথম টিউব রেল। তখন গ্যাসের বাতি লাগানো কাঠের কামরা টানত স্টিম ইঞ্জিন। সুড়ঙ্গের মধ্যে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ধোঁয়া-ধুলোয় যাত্রীদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনা নিত্যদিনের সমস্যা ছিল। তবু কিন্তু ওই শহরে টিউব রেলের জনপ্রিয়তা কমেনি।
টিউব রেলের জন্য শুরুতে ‘কাট অ্যান্ড কভার’ পদ্ধতিতে উপর থেকে মাটি কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল। পরের দিকে জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তির ঝঞ্ঝাট এড়াতে বর্তমান মনুমেন্ট স্টেশন থেকে দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের স্টকওয়েলের মাঝে মাটির গভীরে জোড়া সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। ১৮৯০ সালে সে পথে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেন চলে।
এ শহরের পাতাল রেলের রিপোর্টে ডালরিম্পল জানান, উপরের রাস্তা-সহ বিভিন্ন নির্মাণের ক্ষতি এড়িয়ে কী ভাবে সুড়ঙ্গ তৈরি সম্ভব। কলকাতা বন্দরের নির্মাণ কাজে তাঁর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে মাটির নীচে জলের উপস্থিতির কথা এবং সে কারণে আলগা মাটির কথাও উঠে এসেছিল তাতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ শহরে উত্তর-দক্ষিণ পাতাল পথ তৈরির প্রয়োজন পড়বে বলেও অনুমান করেছিলেন তিনি। সেই মতো বর্তমান বি বা দী বাগের কাছে দুই পাতাল রেলপথের সংযোগকারী স্টেশন তৈরির কথাও ভেবেছিলেন। বন্দর সংলগ্ন কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশকে যুক্ত করতে পরিকল্পনা হয়েছিল। অনেক বছর পরে সেই পথেই চক্র রেল তৈরি হয়েছে।
নদীর নীচে সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গঙ্গার দু’ধারে দু’টি কূপ খননের সুপারিশ করেছিলেন ডালরিম্পল। কারণ বায়ুর চাপ ব্যবহার করে নদীর দু’পাশ থেকে সুড়ঙ্গ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তৎকালীন প্রযুক্তিতে নদীর কত গভীরে সুড়ঙ্গ খনন করা সম্ভব, নদী খাতের ক্ষয়ে যাতে সুড়ঙ্গের ক্ষতি না হয় তা-ও দেখেছিলেন তিনি।
রেলের হেরিটেজ দফতর সূত্রের খবর, সে সময়ে ওই প্রকল্প নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। শিল্পপতি রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু কলকাতা থেকে তখন দেশের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ায় এ শহরের দাবি পিছিয়ে পড়ে। টাকার অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিলেতে ফিরে টিউব রেলের কাজে মনোনিবেশ করেন ডালরিম্পল।
১৯৬৯ সালে পূর্ব জার্মানি এবং সোভিয়েত প্রযুক্তিবিদদের পরামর্শে কলকাতা মেট্রোপলিটন প্রোজেক্ট তৈরি হয়। তাতে শহরে পাঁচটি মেট্রো পথের সুপারিশ করা হয়। তার মধ্যে টালিগঞ্জ-দমদম, বিধাননগর-রামরাজাতলা এবং ঠাকুরপুকুর-দক্ষিণেশ্বরের উল্লেখ ছিল। সেখান থেকেই আরও কয়েক দশক পরে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর পরিকল্পনা করা হয়। দিল্লি মেট্রো নির্মাণের অভিজ্ঞতা এবং সাফল্য ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো নির্মাণের পথ প্রশস্ত করে।
কলকাতায় ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পে মাটির নীচে দেশের সব থেকে গভীর মেট্রো স্টেশন তৈরি হচ্ছে হাওড়ায়। পুরনো এবং নতুন কমপ্লেক্সের মাঝে তৈরি হওয়া সেই স্টেশন প্রায় ১০০ ফুট গভীর হচ্ছে। প্রথম পরিকল্পনার অনেক কিছুই হালফিলের ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পে বদল হয়েছে। তবু সেই পরিকল্পনায় যে নিষ্ঠা ছিল, তা শিক্ষণীয় বলে মনে করেন মেট্রো বিশেষজ্ঞেরা।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের সাফল্যের রসদ মেলে ডালরিম্পলের প্রযুক্তির ভাবনা থেকেই। শতবর্ষের দোরগোড়ায় পূর্ব আর পশ্চিমের সেই মিলনকে মনে রাখবে ইতিহাস।