রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। —ফাইল চিত্র।
ডাক্তারির বিভিন্ন পরীক্ষায় সম্প্রতি হবু চিকিৎসকদের গণ-টোকাটুকি ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে বলে জানিয়ে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছেন অভিজ্ঞ সরকারি চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ। তাঁদের দাবি, বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত হোক। অভিযোগকারীরা মূলত বামপন্থী সরকারি চিকিৎসক। তবে তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠনের অনেকেই তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করেছেন।
চিকিৎসকদের অভিযোগ, রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ কথা বার বার জানিয়েও লাভ হয়নি। তাই তাঁরা রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ চান। কারণ, ডাক্তারি আর পাঁচটা কাজের থেকে আলাদা। পড়াশোনা না করে টুকে পাশ করা এমবিবিএস চিকিৎসকের হাতে রোগীর প্রাণ বাঁচানোর ভার দেওয়া মানে তাঁকে কার্যত মৃত্যুর জন্য ছেড়ে দেওয়া। রাজ্যপালকে তাঁরা লিখেছেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষা রসাতলে গিয়েছে। অধিকাংশ পরীক্ষার হলে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় অবজ়ার্ভার বা পরিদর্শক পাঠাচ্ছে না এবং সিসিটিভি বন্ধ করে রাখা হচ্ছে।’
গত ৮ জুন স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথম এ বিষয়ে চিঠি দেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সরকারি চিকিৎসকেরা। কিন্তু অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হয়নি। তাই ১৩ জুন তাঁরা রাজ্যপালকে চিঠি দিতে বাধ্য হন। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুহৃতা পালের অবশ্য দাবি, ‘‘আমরা পরীক্ষা সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক ভাবেই নিয়ে থাকি। তা-ও চিকিৎসকদের অভিযোগ, বাড়াবাড়ি মাত্রায় টোকাটুকি হচ্ছে। আমরা খতিয়ে দেখছি।’’
অভিযোগকারী চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এমবিবিএস স্তরে অজস্র উত্তরপত্রে হুবহু একই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি, ১০০ মাইল-১৫০ মাইল দূরের এক-একটি মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদেরও উত্তর দেখা যাচ্ছে এক! সম্প্রতি এসএসকেএমের এক পড়ুয়ার খাতার মধ্যে ছাপানো উত্তরপত্র মিলেছে। এর থেকে স্পষ্ট যে, আগে থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এবং উত্তরপত্র তৈরি হয়ে বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে বিলি হচ্ছে। একটি বড় চক্র এর মধ্যে কাজ করছে বলে সন্দেহ অভিযোগকারী চিকিৎসকদের।
অভিযোগকারী চিকিৎসকদের অনেকেরই বক্তব্য, ‘‘ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে, তাঁরা এমবিবিএস পড়াকালীনই বিভিন্ন বেসরকারি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে স্নাতকোত্তরের (এমডি, এমএস) জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করছেন। এমবিবিএস স্তরে তাঁরা খাটতে চাইছেন না। পড়াশোনা না করেই পাশ করে যেতে চাইছেন। এরই সুযোগ নিচ্ছে কিছু লোক। তাঁদের মধ্যে শাসকদলের বেশ কিছু নেতা স্থানীয় ডাক্তারও রয়েছেন।’’ চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর ছাত্র নেটওয়ার্কের রাজ্য আহ্বায়ক তথা তৃণমূলপন্থী ছাত্র নেতা মাবাস সিরুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘এমন যে হচ্ছে, সেই অভিযোগ আমরাও পাচ্ছি। যাঁরা এটা পরিচালনা করছেন, তাঁরা নিজেদের তৃণমূল বললেও আসলে তাঁরা তৃণমূল নন। ব্যক্তি স্বার্থে নিজেদের দল ভারী করতে তাঁরা মেডিক্যাল পড়ুয়াদের টোকাটুকির ব্যবস্থা করে দিয়ে বা প্রশ্ন ফাঁস করে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এঁরা তৃণমূলের ও মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষতি করছেন।’’
তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রোগ্রেসিভ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সচিব রৌনক হাজারিরও বক্তব্য, ‘‘কান পাতলেই বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে টোকাটুকি আর প্রশ্ন ফাঁসের কথা শোনা যাচ্ছে। যে সব চিকিৎসক প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার এবং যে সব পড়ুয়া এর মধ্যে থাকতে চাইছেন না, তাঁদের ফেল করানোরও অভিযোগ উঠছে। মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা ন্যক্কারজনক।’’