শ্যামবাজার স্ট্রিট

বাইরের চেহারাটা বদলায়নি, বদলেছে পরিবেশ

গায়ে গায়ে লাগা পুরনো বাড়ি, এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, হাজারো মুখের সারি— সব মিলিয়ে উত্তুরে হাওয়া আমার পাড়াটাকে ঘিরে রেখেছে। আমার বাড়ির পাশেই বহু পুরনো বসাকদের আটচালা শিবমন্দির কিংবা ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের গাইনদের পুরনো বাড়িটা আজও ধরে রেখেছে পাড়ার সাবেক ছবি।

Advertisement

গোপীনাথ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০০:২৭
Share:

গায়ে গায়ে লাগা পুরনো বাড়ি, এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, হাজারো মুখের সারি— সব মিলিয়ে উত্তুরে হাওয়া আমার পাড়াটাকে ঘিরে রেখেছে। আমার বাড়ির পাশেই বহু পুরনো বসাকদের আটচালা শিবমন্দির কিংবা ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের গাইনদের পুরনো বাড়িটা আজও ধরে রেখেছে পাড়ার সাবেক ছবি।

Advertisement

চার-পুরুষ আমাদের এই পাড়ায় বসবাস। আমাদের বাড়িটারও একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আমার পাড়ার চৌহদ্দি যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে শোভাবাজারের মোড় পর্যন্ত। এর ভিতরে রয়েছে রাজনারায়ণ বিশ্বাস লেন, হেম কর লেন, হেম কর বাইলেন আর রামচন্দ্র মৈত্র লেন। এই সব নিয়েই আমার পাড়ার ব্যাপ্তি। আজ ৭৬ বছর এখানেই আছি। এক কথায় নিরুপদ্রব, শান্ত একটি পাড়া।

পাড়ার কথা বলতে গেলেই ঘুরে ফিরে সেই পুরনো দিনের কথা মনে আসে। তবে আগের সব কিছুই ভাল ছিল আর বর্তমানের সব কিছু খারাপ এমনটা কিন্তু নয়। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন তো আসবেই, আর সেটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলাই জীবনের রীতি।

Advertisement

দেখে ভাল লাগে আগের তুলনায় এ পাড়ার নাগরিক পরিষেবা উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট অনেক পরিচ্ছন্ন থাকছে। আলোয় চারদিক উজ্জ্বল। তা ছাড়া নিয়মিত জঞ্জালের ভ্যাটগুলি পরিষ্কার করা হয়। জল জমার সমস্যাও নেই। তবু কিছু ব্যাপারে আক্ষেপ রয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে বাড়ির সামনের রাস্তার বেশ খানিকটা অংশ খোঁড়া হয়েছিল। তাতে মাটি চাপা দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত সেটি মেরামতি হয়নি। কারণ, রাস্তাটি নাকি আট নম্বর আর ন’নম্বর ওয়ার্ডের মাঝামাঝি ছিটমহলের মতো। কেউ সেটা সারাতে উদ্যোগী হচ্ছেন না। এটা খুবই দুঃখজনক।

আগে পাড়ায় রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে কোনও বিভেদ ছিল না। যেমন, কাছেই রাজবল্লভপাড়াকে আমরা বলতাম মস্কোর রেড স্কোয়্যার। তখন সেটা সিপিআই-এর কেন্দ্রস্থল ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। সেই রাজনৈতিক উদারতা আর নেই।

আজকের তুলনায় সে কালে ছোটরা খেলাধুলোয় অনেক বেশি আগ্রহী ছিল। আমরা সদস্য ছিলাম শ্যামবাজার স্পোর্টিং ক্লাবের। আমার প্রয়াত দাদা ইলাবন্ত ঘোষের নেতৃত্বে পাড়ায় তরুণদের সমবেত করা হয়েছিল খেলাধুলোয় উৎসাহিত করার জন্য। তখন শ্যামবাজার স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত ফুটবল ও ক্রিকেট খেলত শ্যাম স্কোয়ারে, কখনও টালা পার্কে, কখনও বা ময়দানে। এ ছাড়াও পাড়ার রাস্তায় খেলাধুলোর চল ছিল। বিশেষ করে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটায়। এখানেই প্রখ্যাত ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের ভাই নিমাই রায়ও এক সময় খেলেছেন। ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলা হত রবার বল।

অন্য একটি মাঠে শীতে জোরালো আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন খেলা হত। আজ যেখানে ওই পেট্রোল পাম্পটা দাঁড়িয়ে, সেখানেই ছিল আমাদের খেলার মাঠ। পাড়ার খেলাধুলোর পরিবেশটা বদলেছে। ছোটরা টি‌ভিতে কিংবা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতে ভালবাসে কিন্তু নিজেরা মাঠে নেমে খেলতে চায় না। জানি না কেন ছোটদের খেলার সেই উৎসাহটাই আজ আর নেই!

রোজ সন্ধ্যায় আঁকশি দিয়ে গ্যাস বাতির আলো জ্বালিয়ে যেত, আর ভোরে নিভিয়ে যেত একটি লোক। সেই আলো-আঁধারিতে পাড়াটাকে মায়াবী রূপকথার মতো বলেই মনে হত। বাড়ির পাশেই ফুটপাথে ছিল একটি চাপাকল। তাতে জল সরাসরি আসত গঙ্গা থেকে। তখন জলের চাপ এতটাই তীব্র ছিল যে আমাদের দোতলার কলে কোনও রকম পাম্প ব্যবহার না করেই জল উঠে যেত। ভোর চারটের সময় হোসপাইপ দিয়ে রাস্তা ধোওয়া হত। সকালে রাস্তা ঝকঝক করত। এমনকী পাড়ার ভিতরে গলিগুলিও ধুতো ভিস্তিওয়ালারা। চারপাশটা বেশ পরিচ্ছন্ন থাকত।

সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে সেই সব অনেক কিছুই। ভিস্তিওয়ালার মতোই অনবদ্য ছিল ফেরিওয়ালারা। তাঁদের হাঁক শুনলেই আমদের মনটা নেচে উঠত। পাড়ায় সেই ফেরিওয়ালার ডাক, যা থেকে বোঝা যেত পাড়ার পরিচিত চরিত্রটা। দিনের এক এক সময় এক এক জন ফেরিওয়ালা হাজির হত। ওদের হাঁক শুনে বোঝা যেত কত বেলা হল। আজ তাঁদের খুঁজে পাই না।

তেমনই আমাদের পাড়া থেকে উধাও ঘুড়ি ওড়ানোর পুরনো সেই ঐতিহ্যটা। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে সকাল থেকে দল বেঁধে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানো কিংবা কাটা ঘুড়ি ধরার জন্য তার পিছনে ধাওয়া করার সেই আকর্ষণটাই আজ ধূসর মলিন স্মৃতি মাত্র।

আমাদের গর্ব ছিল পাড়ার কিছু মানুষকে নিয়ে। বাড়ির কাছেই থাকতেন কাজী নজরুল ইসলাম, যদিও সেই সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন। আর ছিলেন তাঁর পুত্র কাজী সব্যসাচী, ও কাজী অনিরুদ্ধ। ষাটের দশকে এ পাড়ারই অরূপ গাইন ‘হবি রিদম’ নামের একটা অর্কেষ্টার সূত্রপাত করেছিলেন।
পরে সেটি গোটা শহরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

এ পাড়ার পুজোপার্বণ আরও একটি আকর্ষণ। দুর্গাপুজোর পাশাপাশি আমাদের শ্যামবাজার স্পোর্টিং ক্লাবের উদ্যোগে সরস্বতী পুজো হত। শ্যামবাজার স্ট্রিট সর্বজনীনের দুর্গোৎসবের মুক্ত অঙ্গনে এক সময় গান গেয়ে গিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আমাদের বাড়ির নীচের ঘরে বসে কাজী সব্যসাচী অনুষ্ঠানের ঘোষণা করতেন। আর নিনিদা মানে কাজী অনিরুদ্ধ সেই অনুষ্ঠানে গিটার বাজাতেন। সেই পুজোটাও আজ স্মৃতি।

সত্যি কথা বলতে কী তখন পাড়ার পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। পরস্পরের সঙ্গে ছিল এক অন্তরঙ্গ আন্তরিক সম্পর্ক। মনে পড়ে যায় পাড়ার অরুণদা, ইয়াদার কথা যাঁরা মানুষের বিপদে-আপদে সব সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে অকৃপণ ভাবে সাহায্য করতেন। আগে এই পাড়ায় থাকতেন বেশ কয়েকটি স্বর্ণকার পরিবার। তাঁরাই বা এখন কোথায় গেলেন?

ক্রমেই ভেঙে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলি। এই পাড়াও তার ব্যতিক্রম নয়। শুধু একসঙ্গে থাকা খাওয়াই নয়, সুখ দুঃখ ভালবাসা ভাগ করে নেওয়ার সেই অনুভূতি আর বন্ধনটাই এখন যেন পুরোপুরি হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ পাড়ার মানুষের মধ্যে সেই আন্তরিকতার বন্ধন আর দেখি না। পাড়ার মানুষের মধ্যে যোগাযোগটাও কেমন যেন কমে আসছে। বিপদে-আপদে আর সে ভাবে সবাই এগিয়ে আসেন না। দিনে দিনে পাল্টে যাচ্ছে পাড়ার আড্ডাও। পরিবর্তন শুরু সেই সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় থেকে। যাঁদের বাড়িতে রক ছিল সেই অস্থিরতার সময়ে তাঁরা অচেনা ছেলেদের রকে বসে আড্ডা দিতে বাধা দিতেন। কেউ কেউ আবার অন্য একটি ব্যবস্থাও নিতেন। তা হল, রকগুলি ঢালু করে তাতে কাচ কিংবা স্টোন চিপ্‌স বসিয়ে নিয়েছিলেন। এখনও আড্ডা বসে কিন্তু সেটা গলির মুখে কয়েকটা মাত্র চেয়ার পেতে!

আমাদের পাড়ার চেহারাটা কিন্তু খুব একটা বদলায়নি। অবশ্য তার বড় কারণ বাড়িগুলি এত ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি। ফলে সেই সব বাড়ি প্রোমোটরের হাতে পড়ে নতুন বহুতল করতে গেলে হয়তো অনেকটা জায়গা বাদ চলে যাবে। তাই এটুকুই যা বাঁচোয়া!

লেখক ক্রীড়া সংগঠক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement