আলাপ: নন্দনে ফরাসি পরিচালক অরেলিয়া মোজ্যাঁ। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
শীতের অকাল বাদলে দিনভর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তবু অদম্য শহরের সিনেপ্রেমীরা। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নন্দনে ছবি দেখতে উৎসাহীদের ভিড়ে পুলকিত ফরাসি কন্যা অরেলিয়া মোজ্যাঁ। ভারতীয় প্রমাতামহীর গল্প শুনে আর বাড়িতে মায়ের হাতের মশলাদার ভারতীয় ‘কুরি’ (কারি বা ভারতীয় ঝোলের পদ) খেয়ে বেড়ে ওঠা তরুণী বলছেন, “কলকাতায় আমার ছবিটা নিয়ে আসা সত্যিই সার্থক মনে হচ্ছে।”
২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা কিফের প্রতিযোগিতায় শামিল অরেলিয়ার ‘স্কারলেট ব্লু’ ছবিটি স্যাঁতসেঁতে শহরে অবচেতনের যন্ত্রণা খুঁড়ে আনার কথা বলল। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্কট এখন গোটা বিশ্বে ছেয়ে গিয়েছে। এই পটভূমিতে দ্বিখণ্ডিত সত্তার বিপন্ন মানুষের আখ্যান তাঁর ছবিতে তুলে ধরেছেন অরেলিয়া। ছবির শেষে পরিচালক বলছিলেন, “আমার কিশোরীবেলার প্রিয় বন্ধু একটি মেয়ের সঙ্কটের ছায়া রয়েছে ছবিটায়। ওঁকে ভেবেই ছবিটা লিখতে বসি।”
অরেলিয়ার বন্ধুর মতো ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মহিলাও স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ার শিকার। অরেলিয়া বলছিলেন, “মনের অসুখের ঘোরে আমার বন্ধুটি ওর মাকে খুন করতে গিয়েছিল, আত্মহত্যাও করতে যায়। ঘোরের মধ্যে সে অচেনা, অজানা সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কেও জড়িয়েছে। তারা পুরুষ না নারী, সে বোধও ওর থাকত না। আমার ফিল্মের চরিত্রটিও একই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।”
বাস্তবে অরেলিয়ার বন্ধুটি এখনও মনের অসুখ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাননি। কিন্তু ছবিতে চিকিৎসা তথা কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে দিয়ে চরিত্রটি সুস্থ হয়ে উঠছে। এ ছবির গল্পে মুখ্য চরিত্র অলতের বলে এক মহিলা শৈশবে তাঁর বোনের অপমৃত্যুতে তীব্র মানসিক আঘাতে স্মৃতি খুইয়ে ফেলেন। মনের অসুখে নিজের মাকেও তিনি শত্রু ভাবতেন। ছবির শেষটায় এই অবস্থা থেকে তিনি মুক্তি পান। অরেলিয়া বলছিলেন, ‘‘মনের অসুখের তো দেশ, কাল নেই! আমি সহমর্মিতার সঙ্গে গল্পটা বলতে চেয়েছি!” ছবি কেমন লেগেছে শুনতে উৎসুক হয়ে অরেলিয়া জানতে চাইছিলেন, “মনের অবচেতনের নানা ক্ষত রং ও ছবির মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সহজ ছিল না। ভাল লাগছে, কলকাতার দর্শক মন দিয়ে ছবিটা বোঝার চেষ্টা করলেন।”
বৃষ্টি দিনে ফরাসিনি চিত্র পরিচালক নিজের ছবি ছাড়াও পুদুচেরী থেকে আসা তাঁর ভারতীয় প্রমাতামহীর গল্প বলতেও মশগুল। পাঁচ বছর আগে তাঁর প্রথম ছবি ‘ফরনাসি’ কলকাতায় দেখানো হয়। সে ছবি পরে ওটিটি মাধ্যমে এসেছে। এটি অরেলিয়ার দ্বিতীয় ছবি। তবে অরেলিয়ার কোনও ছবিই এখনও পর্যন্ত ফ্রান্সে বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পায়নি।
দুপুরে উৎসব অঙ্গনে অসমিয়া ছবির পরিচালক পার্থজিৎ বড়ুয়া বা মণিপুরি ছবির পরিচালক হাওবাম পবন কুমারেরাও বলছিলেন, তাঁদের মনের মতো ছবি দেখানোর পরিসর গোটা দেশেই সঙ্কুচিত। পবন তাঁর ছবির অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, সম্পাদক শঙ্খজিৎ বিশ্বাস, সাউন্ড ডিজাইনার সুকান্ত মজুমদারদের পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘জাতি সংঘর্ষ ও অশান্তিদীর্ণ মণিপুরে জনজীবনের ছোট ছোট সঙ্কটে এখন সিনেমার উপাদান ঠাসা।’’
পবনের ‘জোসেফ’স সন’ ছবিটি এ দিন নন্দন-২ প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়েছে। শনিবার বেলা ১১টায় ফের রাধা স্টুডিয়োয় দেখানোর কথা। সমস্যায় ধ্বস্ত মণিপুরে ফুটবল খেলতে গিয়ে একটি ছেলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে টানাপড়েনের আখ্যান। ১৯৮০-র দশকে অসমের নেলি হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে পার্থজিৎ বড়ুয়ার ‘নেলির কথা’ আজ, শুক্রবার সকালে সল্টলেকে রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে রয়েছে। ঘটনাচক্রে ছবিটি সন্ধ্যায় অসমেও মুক্তি পাবে। পার্থজিৎ বললেন, “মেরুকরণের দিনকালে অসমে নেলির ঘটনা নিয়ে অনেকেরই এখনও মুখে কুলুপ! চেষ্টা করেছি নানা অশ্রুত স্বর মেলে ধরতে।” উৎসবের সিনে-ভোজ অন্তরে-বাহিরে এমন অনেক নীরবতা ভাঙার স্পর্ধা এনে দিল।