উন্মাদনা: গলি থেকে রাজপথে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ভক্তেরা।
ধুম জ্বর!
পারদ চড়ছে হু হু করে।
চিকিৎসকেরা নিদান দিয়েছেন আগামী ১৫ জুলাইয়ের আগে এ জ্বর ছাড়বে না। অগত্যা করারই বা কী আছে। বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আগামী ৩১ দিন ধরে বিশ্বকাপ জ্বরেই কাঁপবে ‘ফুটবলের মক্কা’ কলকাতা।
১৯৪২-এর পটভূমিতে তৈরি ‘সপ্তপদী’ ছায়াছবিতেও উঠে এসেছিল বাঙালির ফুটবল আবেগ। যেখানে মেডিক্যাল ছাত্র তথা ফুটবলার কৃষ্ণেন্দু হারিয়ে ছিল গল্পের নায়িকা রিনা ব্রাউনের সাহেব দলকে। আবার হাটখোলা শিল্ডকে কেন্দ্র করে বগলা আর মনসার প্রেমকথাও ফুটে উঠেছিল ‘ধন্যি মেয়ে’তে।
সেই প্রেমের সূত্রেই মাঝেমধ্যে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের খেলাকে কেন্দ্র করে শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে জমে ওঠে গলদা চিংড়ি বনাম ইলিশের লড়াই। এখন অবশ্য সেই লড়াইয়ে ৩১ দিনের বিরতি টেনে রাশিয়ার ময়দানের যুদ্ধে মেতেছে শহরের আট থেকে আশি। আর তাদের হাত ধরেই রাতারাতি যেন অল্পবিস্তর পাল্টে গিয়েছে চেনা শহরটা।
এলাকার শ্যাওলা-ধরা দেওয়াল কিংবা তস্য গলির আকাশও এখন বিশ্বকাপের তাপে তেতে উঠেছে। নির্বাচনের সময়ের মতো রাজপথ থেকে তস্য গলির দেওয়ালও এখন ভাগাভাগির পালা— রংতুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠছে পায়ে বল নিয়ে দৌড়নো মেসি, কোথাও আবার জয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত নেইমার। আবার রাস্তার এপার-ওপার যেন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সীমানা। এক পাশে মেসির কাটআউট তো আর এক পাশে নেইমারের। আবার বিকেলের ঝোড়ো হাওয়াতে সব এলাকাতেই রাজপথ থেকে তস্য গলির মাথাতেও পতপত করে উড়ছে বিভিন্ন দলের পতাকা। যেমন নেতাজিনগরের একটি ক্লাব প্রায় ৩০০ ফুটের ব্রাজিলের পতাকা ওড়াচ্ছে।
প্রিয় দলের জন্য রাজারহাটে চলছে যজ্ঞ।
গোটা শহরটাই এখন ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনায় মজে আধাআধি ভাগ হয়েছে। তাতে বাদ নেই বাবা-ছেলেও। যেমন উত্তর কলকাতার গৌতম কুণ্ডু নেইমারের ভক্ত হলেও তাঁর সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলের ধ্যানজ্ঞান মেসি। আবার বাগবাজারের হৃষীকেশ ঘোষ বাড়ি জুড়ে ব্রাজিলের পতাকা টাঙানোর পাশাপাশি আলমারির রংও করিয়েছেন হলুদ। অনেকে আবার প্রিয় ক্লাবের মঙ্গল কামনায় করছেন যজ্ঞ।
শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিশ্বকাপের পারদ চড়ছে। ধর্মতলার বিধান মার্কেট ছেয়ে গিয়েছে বিশ্বকাপের জার্সি, পতাকায়। মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে ভিতরের দোকানে ঝুলছে হরেক সাইজের জার্সি। একেবারে পাতলা হলে, দাম ৮০ থেকে ১০০, মাঝারি মানের ১৫০ আর চায়নার জার্সি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ‘‘এই সময়টাই দু’টো টাকা বেশি রোজগার হয়। তাই যে যেমন খুশি দাম হাঁকে।’’ সহাস্য জবাব এক জার্সি বিক্রেতার।
শহরটার মতো ভাগাভাগি জার্সি বিক্রির বাজারও। দোকানিরা বলছেন, দাঁড়িপাল্লায় মাপলে কখনও বাজার উঠছে ব্রাজিলের তো কখনও আর্জেন্টিনার। এক দোকানি বললেন, ‘‘ব্রাজিলের জার্সির খুব চাহিদা রয়েছে। প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না।’’ বাজার জুড়ে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেনের জার্সির চাহিদাই বেশি। যদিও পারদ আরও চড়লে তবেই বাজার জমবে বলে দাবি পতাকা-বিক্রেতা উৎপল সাহার। তিনি জানান, স্ক্রিন প্রিন্ট করা আর্জেন্টিনার ১০ ফুটের পতাকার দাম ৩০০ টাকার মধ্যে। আর এমব্রয়ডারির কাজ করা ব্রাজিলের পতাকার দাম প্রায় ৬০০ টাকা।
মাঠের লড়াই অবশ্য এখন শহরের আকাশেও। তাই দম ফেলার সময় নেই বৌবাজারের অজিত, কুতুবুদ্দিনদের। কাগজ জুড়ে ওঁরাই এখন বানাচ্ছেন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানির পতাকা আঁকা ঘুড়ি। আবার ফুটবল-পাগল ভক্তদের জেরে বদলেছে শহরের পার্লার থেকে সেলুনও। শাহরুখ, সলমনের হেয়ারকাট ছেড়ে নেইমার-মেসির আদলে চুল ছাঁটছেন অনেকে। কেউ আবার প্রিয় দলের লোগো আঁকতে লাইন দিচ্ছেন ট্যাটু সেন্টারে। প্রিয় দলের জন্য এমনই বাঁধভাঙা আবেগ, ভাঙা হাতের প্লাস্টারেও ব্রাজিলের হলুদ-সবুজ রং করিয়েছেন এক তরুণ।
৩১ দিন ধরে ৩২টি দেশের দাপাদাপি দেখাতে টিভির বাজারেও এখন চলছে দেদার গিফট, ছাড়ের রমরমা। রেস্তোরাঁ থেকে হোটেল সাজছে ৩২টি দেশের চেন-পতাকায়। এই মহারণে অবশ্য শহরবাসীর আর এক অস্ত্র সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ। তাতেই ছড়াচ্ছে হরেক কিসিমের জোকস থেকে ছবি।
তবে গায়ে জ্বর নিয়ে এই ক’দিন শহরে থাকতে নারাজ খিদিরপুরের ৮৫ বছরের পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়। ৭৫ বছরের স্ত্রী চৈতালীদেবীকে নিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন রাশিয়ায়।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেললে স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্তী হওয়া যাবে। মহানগরের ফুটবলপ্রেমী আট থেকে আশির মাসখানেকের ধ্যানজ্ঞান-স্বর্গ আপাতত রাশিয়া, বললে ভুল হবে কি?
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও দীপঙ্কর মজুমদার