লেলিহান: কালীপুজোর সন্ধ্যাতেই অঘটন। শনিবার, গৌরাঙ্গনগরের নিবেদিতা পল্লিতে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
আতশবাজির বাড়াবাড়ি ছিল না। তবে দীপাবলির মরশুমে এমন আগুনের উচ্ছ্বাস দেখতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি সল্টলেক-নিউ টাউন ছাড়িয়ে জ্যাংড়া-হাতিয়াড়া-২ পঞ্চায়েত এলাকার গৌরাঙ্গনগরের নিবেদিতাপল্লির বাসিন্দারা। সেখানে কালীপুজোর রাতের আগুনে কয়েকশো মানুষের বাসস্থান পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। তবে প্রাণহানির কোনও খবর নেই বলেই পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ বাঁশের মাচায় একটি খুপরি ঘরে সামান্য আগুনের ফুলকি দেখা যায়। তার পরে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে যায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা অজস্র বাড়িতে। দমকলের ১০টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। তবে সরু, অপরিসর পথে তারা খুব বেশি দূর এগোতে
পারেনি। রিলে পদ্ধতিতে জল ঢালার চেষ্টা চলে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ঘরবাড়ি বা কোনও রকম সামগ্রী বাঁচানো সম্ভব হয়নি। করোনা বা আমপানে কাবু হলেও এত বড় সঙ্কটের মুখে কখনও পড়েননি স্থানীয় বাসিন্দারা। বেশির ভাগই দিন আনি-দিন খাই মানুষ। কেউ নির্মাণকর্মী, পরিচারক-পরিচারিকা বা অ্যাপ-ভিত্তিক খাবারের ডেলিভারি বয়। স্থানীয় বাসিন্দা জয়ন্ত মণ্ডলের কথায়, ‘‘আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ায় বিকট শব্দে ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ফাটতে শুরু করে। বাচ্চা বা বয়স্কদের নিয়ে বেরোনো গিয়েছে, এটাই রক্ষে! টিভি, ফ্রিজ, আসবাবপত্র, সাইকেল, মোটরসাইকেল— কিচ্ছু বাঁচানো গেল না।’’ মজা পুকুরের ধারে বাঁশের মাচার বাড়িগুলোর বেতের দেওয়াল। ধারে চাঁচের বেড়া। ফলে, সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
পেশায় খাবার সরবরাহকারী এক তরুণ তারক সরকার এ দিন সন্ধ্যায় বড়বাজারে খাবারের প্যাকেট পৌঁছচ্ছিলেন। খবর পেয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরেন তিনি। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, ভাই ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের সাত দিনের শিশু। শিশুটি অসুস্থ ছিল। তাকে কোনও মতে বিপর্যয়ের সময়ে বাইরে বার করে আনেন পরিবারের লোকজন। কিন্তু আর কিছু বাঁচানো যায়নি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ তারক বলছিলেন, ‘‘আমার মিলিটারির পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সব মার্কশিট পুড়ে গিয়েছে। জীবনটাই শেষ হয়ে গেল।’’ পাশের বড়পুকুর এলাকায় একটি কালীপুজোর মণ্ডপও দুর্যোগে লন্ডভন্ড। অমাবস্যার রাতে পুজো মাথায় উঠেছে।
দমকলের বক্তব্য, বিধাননগর দমকল কেন্দ্র থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছতেই তাদের কালঘাম ছোটে। নিউ টাউনে ইকো পার্কের পাশের একটি রাস্তা দিয়ে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। কিন্তু নিবেদিতাপল্লি লাগোয়া এক-দেড় কিলোমিটার ধরে কার্যত রাস্তা নেই। ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ ব্যবহার করে কোনও মতে রাস্তা খাড়া করা হয়েছে। সেখান দিয়ে ইঞ্জিন তো দূরের কথা, সাধারণ গাড়ি চলাচলও দুঃসাধ্য। এর ফলেই আগুন নেভাতে দেরি হয়। তত ক্ষণে বাসিন্দারা বেশির ভাগই কার্যত নিঃস্ব। তবে বাড়ির পাশে পুকুর থাকায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে। পুকুরের জলেই মোটামুটি আগুন মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য
অনিমেষ মণ্ডলও আক্ষেপ করছিলেন, রাস্তার অবস্থা আর একটু ভাল হলে এমন হত না।
বিপর্যয়ের জেরে দেখা গেল, করোনাকালের নিরাপত্তা-বিধিও সব টালমাটাল। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রের খবর, অন্তত ২৬টি পরিবার পুরোপুরি দিশাহারা। তাদের সবাইকে ঘেঁষাঘেঁষি করে এক ছাদের নীচে রাখা হয়েছে। তপসিয়ার একটি বস্তিতেও এমন বিধ্বংসী আগুন দেখা গিয়েছিল। সেখানেও উৎসবের রাতে আগুনের গ্রাস গোটা মহল্লাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে।