ঢাকে কাঠির শব্দে দুর্গার আগমন-বার্তা। তবে ওঁদের ঘরে ভিন্ন রূপে নিত্য বসত দুর্গতিনাশিনীর। তাঁদেরই খোঁজে আমরা
Disease

প্রতিদিনের অঞ্জলিতে ভরে ওঠে মা-মেয়ের উঠোন

পুজোর দিনগুলোয় ধূপগুড়ি ব্লকের কুর্শামারি গ্রামের আনাচেকানাচে রঙিন প্রজাপতি হয়ে উড়ত সেই মেয়ে। সাত মাইল দূরের জলঢাকায় বিসর্জন। সে দিন মন খারাপের জল উপচে দিত নদী।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:১৫
Share:

বিয়ের বছর ঘুরতেই কোলে আসে মেয়ে। প্রতীকী ছবি।

কুর্শামারির সবুজ প্রান্তর পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটা দিনে দু’বার ঢুঁ মারত ঠাকুর গড়া দেখতে! তিল তিল করে প্রতিমা গড়তেন কলকাতা থেকে গ্রামে যাওয়া কুমোর। আগে গ্রামের একমাত্র বাড়ির প্রতিমা, তার পরে হাটের প্রতিমা। তাই অনেক দিন ধরে প্রতিমা তৈরির সাক্ষী থাকত সে-ও। কখনও বন্ধুদের সঙ্গে, কখনও একা। সেই সঙ্গে চলত পুজোর প্রহর গোনা। বাবা আর মামার বাড়ি মিলিয়ে দাদা-বোনের বরাদ্দ হত খান তিনেক নতুন জামা। মায়েরও জুটত অবশ্য। বংশ পরম্পরায় বাবা পুরোহিত, সংসারে তাই কাপড়ের অভাব ছিল না।

Advertisement

পুজোর দিনগুলোয় ধূপগুড়ি ব্লকের কুর্শামারি গ্রামের আনাচেকানাচে রঙিন প্রজাপতি হয়ে উড়ত সেই মেয়ে। সাত মাইল দূরের জলঢাকায় বিসর্জন। সে দিন মন খারাপের জল উপচে দিত নদী। ফের প্রতীক্ষা। ১৩টা বসন্তের জীবনে ক’টাই বা আর পুজো পেয়েছিল মেয়ে! তবু সেই স্মৃতি আজও জাগিয়ে রাখে কিশোরীবেলা। বাবা-মা আর দাদাকে নিয়ে সেই লিপিকা চক্রবর্তীর সুখের ঢেউ ঠেকেছে শিলিগুড়ির আশ্রমপাড়ায়। বিয়ের বছর ঘুরতেই কোলে আসে মেয়ে।

মেয়ে কেন উল্টোয় না? কন্যার বছর দুয়েক বয়স যখন, তখন থেকেই ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়ে অবশেষে বেঙ্গালুরুর এক হাসপাতাল জানায়, এ মেয়ে বিরল রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে আক্রান্ত। শুরু হয় চতুর্দশী মায়ের লড়াই। দায়িত্বের বহর দেখে হাসপাতালে ভর্তি মেয়ে-সহ বৌকে ফেলেই পিঠটান দিলেন তরুণী ভার্যার স্বামী। চার দিকে খোঁজখবর, থানায় ডায়েরি করেও টিকি মেলেনি তাঁর। ভাঙল পাঁচ বছরের খেলাঘর।

Advertisement

দাদা বলতেন, “কোনও খারাপ কথা চিন্তা করবি না। শুধু মেয়েকে ভাল রাখার কথাই ভাববি। যে গিয়েছে, সে গিয়েছে। যা আছে, তাকে নিয়েই এগোতে হবে তোকে। নিজে মনের আনন্দে থাকলে, লড়াইটা অনেক সহজ হবে”— ফোনের ও প্রান্ত থেকে ধীরেসুস্থে বললেন লিপিকা। ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শিলিগুড়িরই স্থানীয় চিকিৎসকের সহায়তায় মেয়েকে যেটুকু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর পরে ওই চিকিৎসকেরই পরামর্শে অন্য এক শিশুরোগ চিকিৎসককে দেখাতে মেয়েকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। জানতে পারেন, তাঁর স্মৃতির মতো এমন আরও বাচ্চার লড়াইয়ের কথা।

যোগাযোগ হল এসএমএ রোগীর অভিভাবকদের সংগঠনের সঙ্গে। লিপিকার কথায়, “এর পরে আমাকে কিছুই করতে হয়নি। ওই সংগঠনের দায়িত্বে থাকা মৌমিতা ঘোষ দিদিই আমায় পথ দেখিয়ে ঠেলে নিয়ে গিয়েছেন। লেখাপড়াই জানি না। আমার হয়ে যাবতীয় চিঠি লেখা, স্মৃতির শিরদাঁড়ায় অস্ত্রোপচারের ডাক্তার এবং ওর চিকিৎসার খরচের জন্য ফান্ড তৈরি করা― সবই মৌমিতাদির অবদান। ওঁর জন্যই ওই বিপুল দামের ওষুধ কিনে মেয়েটাকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।”

মেয়েকে দেখাশোনার দায়িত্ব লিপিকা একা হাতেই সামলান। তাই একটি মাত্র বাড়িতে রান্নার কাজ করেন, তাঁরা মাসে হাজার সাতেক টাকা দেন। ভুলতে চান না ওই পরিবারের অবদানও। মা-বাবা আর দাদা-বৌদি নিজেদের শত কষ্ট সত্ত্বেও লিপিকার সংসার দেখছেন হাসিমুখে! যে দিন বাড়িওয়ালা জানলেন বারোয়ারি শৌচাগারে স্মৃতির কষ্ট হয় খুব, সে দিন নিজে থেকেই ঘরের একচিলতে জায়গা ঘিরে কমোড বসিয়ে দিয়েছেন।

পুজোর ক’টা দিন আশ্রমপাড়ার বাড়ির কাছেই একটি মন্দিরে দুর্গাপুজো আর ভোগের রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বাবা-মা। বোনঝি ভালবাসে, তাই দাদাও রোজ পাঁঠা, মুরগির মাংস কিনে পাঠিয়ে দেন। মনের আনন্দে রান্না করেন লিপিকা। স্মৃতি কেবল তাঁর হাতেরই রান্না খেতে ভালবাসে। বেশি ভালবাসে বিরিয়ানি। বাইরের খাবার মোটে খায় না সে। দুই ভাই-বোনের পরিবার একসঙ্গে পুজোর ক’টা দিন আনন্দে মেতে থাকে।

ভাড়া বাড়িতেও এত লোকের ভালবাসা ঘিরে থাকে মা-মেয়েকে যে, মন খারাপের ফুরসতটাই পান না। পুজোয় নতুন জামার অভাব হয় না স্মৃতির। কিন্তু মণ্ডপে অঞ্জলি দিতে যায় না সে। কারণ, সেখানে তার দিকে ঘোরাঘুরি করা দৃষ্টি অস্বস্তিতে ফেলে স্মৃতিকে। তাই লিপিকাও যান না মণ্ডপে। ওঁদের বারো ঘর এক উঠোনের মণ্ডপে নিত্যদিন চলে অঞ্জলি। ভালবাসার অঞ্জলি, ভাল রাখার অঞ্জলি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement