অশক্ত হাতেই মেয়ে দিওতিমাকে কেক খাওয়াচ্ছেন সন্দীপ সরকার। নিজস্ব চিত্র
সময় থমকে দাঁড়িয়েছে তাঁর মনের জোরের সামনে। ন’বছর ধরে সময়ের সঙ্গেই যেন লড়াই চলছে তাঁর। শেষ ইচ্ছা, মেয়ের বিয়ে দেখা। বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠান আর কয়েক দিন বাদেই। কিন্তু সময় যেন আর সময় দিতে নারাজ। তেমনটাই আশঙ্কা তাঁর পরিবার ও চিকিৎসকদের। তাই তাঁর চোখের সামনে অন্তত মেয়ের বিয়ের রেজিস্ট্রিটুকু হতে পারে, তারই ব্যবস্থা করল হাসপাতাল।
মঙ্গলবার হাওড়ার এক হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া বাবার সামনেই তাঁর মেয়ের সরকারি মতে বিয়ে হল। হাসপাতালের ঘরে সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শরীর যেন আর সঙ্গ দিতে চাইছে না। এ দিনও ৬১ বছরের সন্দীপকুমার সরকারের শারীরিক সমস্যা বেড়েছিল। অক্সিজেন নিতে পারছিলেন না। ফলে উৎকণ্ঠায় ছিলেন পরিবারের সকলেই। মেয়ে-জামাইও চিন্তায় ছিলেন সব কিছু ভালয় ভালয় মিটবে কি না, তা ভেবে।
তবে হাল ছাড়তে রাজি ছিলেন না রেলের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সন্দীপবাবু। ২০১১ সাল থেকে তিনি জিভের ক্যানসারে আক্রান্ত। মুম্বইয়ের একটি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বর্তমানে হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অপরাজেয় সন্দীপবাবু অবশ্য শেষ পর্যন্ত মেয়ের রেজিস্ট্রির শংসাপত্রে নিজেই সই করলেন। কেক কেটে অতিথিদের মুখে কেকের টুকরো তুলেও দিলেন। যদিও সন্ধ্যায় ফের তাঁর অস্ত্রোপচার হয়।
আরও পড়ুন: অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের ‘ক্লোজ’ করে তদন্ত শুরু, সামনে আসছে পর পর গাফিলতি
বরাহনগরের বাসিন্দা, সন্দীপবাবুর মেয়ে দিওতিমা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে শারীরবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। তাঁর সঙ্গে এ দিন বিয়ে হল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিক সুদীপ্ত কুণ্ডুর। মেয়ের কথায়, ‘‘অদ্ভুত অনুভূতি। আমাদের নতুন জীবন শুরু হল অথচ বাবার জীবন শেষের পথে। চিকিৎসায় আর সাড়া দিচ্ছেন না। শুধু আমাদের একসঙ্গে দেখার অপেক্ষায় মনের জোরে লড়াই করছেন। বাবার ইচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য সফল হয়েছে।’’ জামাই সুদীপ্ত বলছেন, ‘‘কয়েক বছর ধরে ওঁর লড়াই দেখছি। এমন মনের জোর কারও দেখিনি। হাসপাতাল থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছেন।’’
আরও পড়ুন: কলকাতায় ফুটপাতবাসীদের উচ্ছেদ, নাইট শেল্টারে আশ্রয়ের দাবি
সন্দীপবাবুর এই লড়াইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী স্ত্রী সুজাতাদেবী। ভবিষ্যৎ কী, তা তিনি আন্দাজ করতে পারেন। তবুও স্বামীর মতো তিনিও হাল ছাড়তে নারাজ। সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘জানতাম উনি পারবেন, পেরেছেন।’’ সন্দীপবাবুর লড়াই আর কত ক্ষণের, তা সময় বলবে। তবে হাসপাতাল কর্মীদের কথায়, ‘‘এমন লড়াই বহু দিন মনে থাকবে। আমরা একটা মুহূর্তের সাক্ষী রইলাম।’’
আর পাঁচ দিন বাকি মেয়ের সামাজিক বিয়ের। হাল ছাড়তে নারাজ সন্দীপবাবু। মেয়ের বিয়ে তিনি দেখবেনই। প্রতিপক্ষ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে লড়াইয়ে রাখতে চাওয়া বৃদ্ধ যেন বলছেন, ‘‘ফাইট সন্দীপ, ফাইট।’’