পরিবার কলকাতাতেই! কিন্তু মা রয়ে গেলেন চিরঅন্তরালে, ‘রূপকথা’র শেষ দেখে ফ্রান্সে ফিরলেন অ্যাঞ্জেলা

‘গঙ্গোত্রী’র সন্ধান অ্যাঞ্জেলা পেয়ে গেলেন। নিখাদ অচেনা একটা দেশে এসে খুঁজে বার করলেন নিজের শিকড়।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:১৭
Share:

মামার সঙ্গে অ্যাঞ্জেলা। —নিজস্ব চিত্র।

অদ্ভুত সফরে বেরিয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে এসেছিলেন রক্তের সম্পর্ক খুঁজতে। এসেছিলেন উৎস স্পর্শ করতে। ‘গোমুখ’ ছোঁয়া হয়তো তাঁর আর হল না, তাঁর গোমুখ পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছে বছর সাতেক আগেই। কিন্তু ‘গঙ্গোত্রী’র সন্ধান অ্যাঞ্জেলা পেয়ে গেলেন। নিখাদ অচেনা একটা দেশে এসে খুঁজে বার করলেন নিজের শিকড়। থেকেও যিনি ছিলেন না, এখন না থেকেও তিনি প্রমাণ করলেন, তিনি ছিলেন।

Advertisement

অ্যাঞ্জেলা কেলড নামটা অপরিচিত না ঠেকারই কথা আনন্দবাজারের অনেক পাঠকের কাছে। বছর বিয়াল্লিশের অ্যাঞ্জেলা সুদূর ফ্রান্স থেকে ভারতে এসেছিলেন মাকে খুঁজতে। জীবনের প্রায় বিয়াল্লিশটা বছরই তাঁর কেটেছে প্যারিসের অদূরে এক ফরাসি শহরে। অনাথ আশ্রমে বা অজ্ঞাতকুলশীল দশায় নয়। বরং সম্পন্ন ফরাসি পরিবারে, মা-বাবার পরম যত্নে। তা হলে আবার কলকাতায় কোন মাকে খুঁজতে আসা? খুঁজতে আসা জন্মদাত্রী মাকে।

বাংলা তথা ভারত তাঁর আসল দেশ, কলকাতায় তাঁর জন্ম, তাঁর জন্মদাত্রী এক জন বাঙালি, এ সব ছোটতেই জেনেছিলেন অ্যাঞ্জেলা। যাঁদের ঘরে তাঁর বেড়ে ওঠা, মুখে বুলি ফোটা থেকে যাঁদের মা-বাবা বলে ডাকা, সেই ফরাসি দম্পতি যে তাঁকে কলকাতার মাদার হাউস থেকে দত্তক নিয়েছিলেন সাত মাস বয়সে, তা-ও অ্যাঞ্জেলা জানতেন। ছোট থেকেই ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা লালন করেছেন অতএব। বিয়াল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে সে ইচ্ছে পূরণ হল। শুধু তাই নয়, লক্ষ্যের খুব কাছেও পৌঁছে গেলেন অ্যাঞ্জেলা। তবু লক্ষ্যটা ছোঁয়া গেল না, তা যেন বায়বীয়ই রয়ে গেল।

Advertisement

আরও পড়ুন: অন্য 'জাতিস্মর'! ভুবন পেরিয়ে কলকাতায় এসে বাঙালি মাকে খুঁজছেন ফরাসি অ্যাঞ্জেলা​

লিলি সিংহ— এই নামটার পিছনে ছুটতে ছুটতেই কলকাতায় এসেছিলেন অ্যাঞ্জেলা। নিজের জন্মসংক্রান্ত নথি থেকেই ওই নামের হদিশ পেয়েছিলেন। উত্তর কলকাতার এক হাসপাতালে তাঁকে জন্ম দেওয়ার পরে লিলি যে আর তাঁর খোঁজ নেননি, খোঁজ কেউ নেননি বলেই যে মাদার হাউসে ঠাঁই হয়েছিল জীবনের প্রথম সাতটা মাস, সে সবই জেনেছিলেন অ্যাঞ্জেলা। তবু তো মা, জন্মদাত্রী তো! জীবনে একটা বার তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না! ভাবতেই পারতেন না অ্যাঞ্জেলা। চৈতি যৌবনে তাই মহাসাগর পেরিয়ে, মহাদেশ ডিঙিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক কাটার পরে জানলেন, আর কখনই দেখা হবে না লিলি সিংহের সঙ্গে।

বছর সাতেক আগে লিলি সিংহ মারা গিয়েছেন। কলকাতায় এসে জানতে পেরেছেন অ্যাঞ্জেলা। আসলে তাঁর এই শিকড় সন্ধানী সফরের কথা কলকাতার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে অনেকেই নিজের উদ্যোগে লিলি সিংহকে খুঁজে বার করতে সচেষ্ট হন। যে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে কলকাতায় এসেছিলেন অ্যাঞ্জেলা, সেই জে এন রায় হাসপাতালের কর্তা সজল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেকে লিলি সিংহ নামের একাধিক মহিলার খোঁজ দিতে শুরু করেন। ওই হাসপাতালেই অ্যাঞ্জেলার জন্ম হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু লিলি সিংহের বিশদ পরিচয় সংক্রান্ত নথি ওই হাসপাতালের কাছে ছিল না। সজল ঘোষের কথায়, ‘‘অনেক লিলি সিংহের খোঁজ আসছিল ঠিকই। কিন্তু আমরা জানতাম যে, আসল লিলি সিংহের খোঁজ মাদার হাউসই দিতে পারবে। তাই ওঁদের সঙ্গেই যোগাযোগ করি। প্রথমে ওঁরা খোঁজ দিতে চাননি। কিন্তু পরে ওঁদের থেকেই খোঁজ মিলেছে।’’

তিন সপ্তাহে কলকাতাকে নানা ভাবে চেনার চেষ্টা করেছেন অ্যাঞ্জেলা। —নিজস্ব চিত্র।

কুমারী মা, সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে পরিচয়টা আর দিতে চাননি। সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়েই সম্ভবত। এত দিন পরে হলেও, সেই মায়ের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে দু’বার ভাবতে হয় বইকি! সে কথা মাথায় রেখেই বোধ হয় প্রথমে লিলি সিংহের পরিচয় গোপন রাখতে চাওয়া হয়েছিল। পরিবারের আপত্তি নেই জেনে পরে তা প্রকাশ করা হয়েছে। তার পরেই অ্যাঞ্জেলা জানতে পেরেছেন যে, তাঁর জন্মদাত্রী আর নেই।

লিলি সিংহের ভাই স্যামুয়েল সিংহ থাকেন বেকবাগানে। মাদার হাউস তাঁর সঙ্গেই দেখা করিয়ে দিয়েছে অ্যাঞ্জেলার। মামা-ভাগ্নি পরস্পরের মুখের ভাষা বোঝেননি ঠিকই, কিন্তু মনের ভাষা মেলানোর জন্য কোনও দোভাষীর প্রয়োজন পড়েনি। দু’জনেই আবেগে আকুল হয়েছেন, চোখ জলে ভেসে গিয়েছে। সামাজিক নীতি পুলিশির চোখ এড়াতে একটা সত্যকে লুকিয়ে ফেলতে হয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর আগে। সময়ের গর্ভে লম্বা ডুব সাঁতার দিয়ে সে সত্য আবার মাথা তুলবে, স্যামুয়েল সম্ভবত ভাবেনইনি কখনও। শিকড় সত্যিই খুঁজে পেয়ে যাবেন প্রথম ভারত সফরেই, বোধ হয় ভাবতে পারেননি অ্যাঞ্জেলাও।

আরও পড়ুন: অনলাইন গেমে আলাপ, আমেরিকায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে লেক গার্ডেন্সের মহিলাকে ২৩ লাখের প্রতারণা!​

ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া কিন্তু খুব সহজ ছিল না অ্যাঞ্জেলা কেলডের পক্ষে। তাঁর ভারতে আসার ইচ্ছাকে বাবা-মা চিরকাল প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু ভারত সম্পর্কে ধারণা খুব ইতিবাচক ছিল না অ্যাঞ্জেলাদের। যে সামাজিক পরিস্থিতির ভয়ে জন্ম দিয়েই সন্তানকে ত্যাগ করেছিলেন লিলি সিংহ, ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে সেই অন্ধকার ধারণাই বদ্ধমূল ছিল অ্যাঞ্জেলাদের মনে। পশ্চিমের মিডিয়ায় ভারত সম্পর্কে যে ছবি ফুটে ওঠে, তাতে ভারতে আসাকে ঝুঁকির কাজ বলেই মনে হত অ্যাঞ্জেলার। নিজেই জানিয়েছেন তিনি। তবু কলকাতায় এলেন আর সপ্তাহ তিনেক কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার আগে জানালেন, যে ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, তার চেয়ে অনেকটা আলাদা ভারতকে চিনে ফিরছেন।

মামা স্যামুয়েলের কাছ থেকে অ্যাঞ্জেলা জেনেছেন, লিলি সিংহের বিয়ে হয়েছিল পরে। কিন্তু সে পরিবারের কেউই আর কলকাতায় নেই। লিলির একমাত্র ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে চলে গিয়েছেন। অতএব ‘হাফ ব্রাদার’-এর সঙ্গেও অ্যাঞ্জেলার দেখা আর হয়নি এ যাত্রায়।

৯ ডিসেম্বর ফিরে গিয়েছেন অ্যাঞ্জেলা। কী নিয়ে ফিরলেন? অন্তরালে থাকা এক জন্মদাত্রীর কথা ভাবতে ভাবতে বড় হয়েছেন। অচেনা দেশ, অজানা ভাষা, অপরিচিত সংস্কৃতি, অদেখা সমাজের এক মহিলা তাঁর আসল মা— রূপকথার গল্পের মতো লাগত অ্যাঞ্জেলার। কিন্তু গল্পটা থেমে ছিল আর অ্যাঞ্জেলা চাইতেন গল্পটার শেষে পৌঁছতে। হয়তো সেই শেষটায় পৌঁছেই অ্যাঞ্জেলা ফিরে গেলেন ফ্রান্সে। কিন্তু মিলনান্তক হল পরিণতিটা, নাকি বিয়োগান্তক, অ্যাঞ্জেলা নিজেও বুঝতে পারছেন না।

রক্তের সম্পর্ক যাঁদের সঙ্গে, সে পরিবারকে খুঁজে পেলেন অ্যাঞ্জেলা। আত্মীয়রা আজ অ্যাঞ্জেলার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা বোধও করলেন না। কিন্তু না দেখা জন্মদাত্রী তাঁর চিরঅন্তরালবর্তিনীই রয়ে গেলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement