সঙ্গীতার ছবি নিয়ে পিসি অণিমা দাস। নিজস্ব চিত্র
‘‘ক্ষিদ্দারা সিনেমাতেই থাকে। বাস্তব আর সিনেমা বড় আলাদা! এখানে না ক্ষিদ্দাদের দেখা মেলে, না প্রশাসন তৎপর হয়।’’
উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের পুরনো বাড়ির ছাদের ঘরে বসে বলছিলেন মহিলা। কান্না চেপে তাঁর মন্তব্য, ‘‘মেয়েটা সাঁতার শিখতে চাইলে বাধা দিইনি। সিনেমায় দেখা কোনি আর ক্ষিদ্দার যুগলবন্দি মাথায় ঘুরত। পরে বুঝেছি, বাস্তবে প্রশিক্ষকের নামে দায়সারাদের ভিড়। মেয়েটা ডুবে গেল, প্রশিক্ষক জানতেও পারলেন না! এত বছর ধরে মামলা লড়ছি, কিন্তু পরিস্থিতি বদলাল কই?’’
২০১৬ সালের ৩১ মে হেদুয়ায় সাঁতারের প্রশিক্ষণ চলাকালীন মৃত্যু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, রামতনু বসু লেনের বাসিন্দা সঙ্গীতা দাসের। তদন্তে জানা যায়, অপেক্ষাকৃত কম গভীরতার সংরক্ষিত জায়গা থেকে হাত ফস্কে কোনও ভাবে গভীর অংশে চলে যান সঙ্গীতা। সেটি সিমেন্টের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল না। ফলে মাত্র দিন পনেরো আগে সাঁতারে ভর্তি হওয়া সঙ্গীতা সামলাতে পারেননি।
সঙ্গীতার পিসি অণিমা দাস জানান, প্রতিদিন ভাইঝিকে সাঁতারে নিয়ে যেতেন তিনিই। তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার দিন অনেকক্ষণ পরেও সঙ্গীতা বেরোচ্ছে না দেখে প্রশিক্ষকদের গিয়ে বলি। ওখানে খাতায় সই করে জলে নামতে হত, উঠে ফের সই করতে হত। খাতায় সঙ্গীতার নামার সই থাকলেও উঠে আসার সই ছিল না। সেটা দেখেও কারও মনে প্রশ্ন আসেনি। আমি চিৎকার করার পরেও কেউ জলে নামেননি। অধিকাংশই বয়স্ক। পরে পাশের ক্লাবের অনেকে নেমে সঙ্গীতাকে উদ্ধার করেন। ওর সঙ্গে আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডুবুরি তো ছিলই না, সঙ্গীতাকে তুলে দিয়েই সকলে পালিয়ে যান।’’ এর পরেই ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বড়তলা থানায় অভিযোগ করেন তাঁরা।
সঙ্গীতার বাবা-মা শাড়ির দোকানে কাজ করেন। পিসি, ঠাকুরমা ছাড়াও রয়েছেন এক মানসিক প্রতিবন্ধী দিদি। কোনওমতে সংসার চালিয়ে এখনও মামলা লড়ে চলেছেন তাঁরা।
ওই ঘটনার পরেই শহরের সাঁতার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে শোরগোল পড়েছিল। প্রশ্ন ওঠে প্রশিক্ষকদের আন্তরিকতা নিয়েই। শহরের সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় পুরসভা। দেখা যায়, ব্যাঙের ছাতার মতো তৈরি হচ্ছে সুইমিং পুল। আর সেখানে কয়েক বছর সাঁতার কাটার পরেই প্রশিক্ষক হিসাবে জলে নামছেন কেউ কেউ। তাঁদের না আছে প্রশিক্ষণ দেওয়ার যোগ্যতা, না আছে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর প্রশিক্ষণ। ‘লাইফ সেভার’ হতে গেলে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষা দিতে হয়। জলের তলায় টানা ৯০ সেকেন্ড থাকা, জলের তলায় ২৫ মিটার সাঁতার কাটার ক্ষমতা, ২২ সেকেন্ডের মধ্যে জামা-জুতো খুলে জলে ঝাঁপানো— এ সবই সেই প্রশিক্ষণের অঙ্গ। কিন্তু এ সবের কোনও বালাই না রেখেই প্রশিক্ষক হয়ে বসছেন কেউ কেউ।
সেই সময়ে পুরসভা নির্দেশ দেয়, সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাতে হলে শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষকের অনুপাত ঠিক রাখতে হবে। রাখতে হবে নজরদারি দল। শিক্ষানবিশদের সাঁতারের জায়গা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকতে হবে, তার গভীরতা হতে হবে ৩-৪ ফুট। ক্লাবে ডুবুরি ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে এক জন চিকিৎসকও রাখতে হবে। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার হবে জল।
তবে এই সব নির্দেশের বেশির ভাগই যে কার্যকর হয় না এবং এ নিয়ে কোনও নজরদারিই চালানো হয় না— তার প্রমাণ ২০১৭ সালের অগস্টে কলেজ স্কোয়ারের ঘটনা। সে দিন জলের তলায় কাঠের পাটাতন এবং সিমেন্টের স্ল্যাবের মধ্যে আটকে মৃত্যু হয় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস’ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া, ‘ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটি’র শংসাপত্র থাকা সাঁতারু, বছর সাতষট্টির কাজল দত্তের। তাঁর পরিবার বলে, ‘‘কাজল যেখানে পারেননি, সেখানে বাচ্চাগুলো পড়লে কী হবে? এখানে লাইফ সেভারই বাঁচে না, ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাবে কে?’’
(শেষ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।