দেবাঞ্জন দেব —ফাইল চিত্র
কসবা-কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবের কি কলকাতা পুর আইন সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা ছিল? নাকি পুরসভারই কেউ তাকে আইন জানতে সাহায্য করেছিল? যে কারণে সে জানতে পেরেছিল, সরকারি দফতর হিসেবে (যেখানে প্রশাসনিক কাজকর্ম হচ্ছে, বাণিজ্যিক লেনদেন নেই) অফিস ভাড়া নিলে তাকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে না? যার ফায়দা তুলে এক দিকে যেমন নিজেকে প্রভাবশালী প্রতিপন্ন করে নির্বিঘ্নে প্রতারণার জাল বিছানো যাবে, পাশাপাশি, পুরসভা-পুলিশের আতশকাচের বাইরেও থাকা যাবে। তদন্তের সূত্রে এমনই অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে।
সোমবার কসবা-কাণ্ড প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘চোখের সামনে কে কী ব্যবসা চালাচ্ছেন, সে বিষয়ে পুলিশ ও পুরসভা দায়িত্ব এড়াতে পারে না।’’ কসবার অফিসের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠছে। পুরসভারই নামে ভুয়ো অফিস খোলা সত্ত্বেও তা কী করে পুরসভা, পুলিশের চোখ এড়িয়ে গেল? তবে কি পুরসভার ‘ভিতরের লোক’-এর সঙ্গে দেবাঞ্জনের আঁতাত ছিল? যে ভাবে দেবাঞ্জন তার প্রতারণার জাল বিছিয়েছিল, তাতে এই সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা পুরসভার এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘পুলিশ তদন্ত করছে। যদি পুরসভার কেউ যুক্ত থাকেন, তবে তা তদন্তে উঠে আসবে।"
পুলিশ সূত্রের খবর, কসবার শান্তিপল্লির যে বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় দেবাঞ্জন পুরসভার ভুয়ো অফিস খুলেছিল, সেখানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিউটি পার্লার, প্রকাশনা সংস্থা, বিমা সংস্থা-সহ মোট ছ’টি ব্যবসার জন্য পুরসভার ‘সার্টিফিকেট অব এনলিস্টমেন্ট’ (চলতি কথায় ট্রেড লাইসেন্স) বা ব্যবসার ছাড়পত্র দেওয়া রয়েছে। ব্যবসা, বাণিজ্যিক লেনদেন, জীবিকা-সহ কাজকর্মের জন্য কলকাতা পুর আইন, ১৯৮০-র ১৯৯ ধারা অনুযায়ী পুরসভা ট্রেড লাইসেন্স দেয়। সেই আইনে এ-ও বলা আছে, প্রয়োজনে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার পরে বা নবীকরণের পরে পুর আধিকারিকেরা সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় আচমকা পরিদর্শনে যেতে পারেন। যদি দেখা যায়, ব্যবসার ছাড়পত্র পাওয়ার আবেদনপত্রে উল্লিখিত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের তফাত আছে, অর্থাৎ, আবেদনপত্রের তথ্যের সঙ্গে অসঙ্গতি রয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা যাবে। পাশাপাশি, যদি তথ্যে জালিয়াতি বা ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যে তথ্য দেওয়া হয়, তা হলে গুরুত্ব বিচার করে লাইসেন্স প্রাপকের বিরুদ্ধে পুরসভা ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সরকারি দফতরের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সের দরকার নেই। ফলে পরিদর্শনেরও প্রশ্ন নেই। ভুয়ো অফিস খোলার ক্ষেত্রে এই নিয়মকে দেবাঞ্জন নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল কি না, আর এই কাজে পুরসভার ভিতরের কেউ সাহায্য করেছিল কি না, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
ওই বিল্ডিংয়ের অন্য অফিসের কর্মীদের একটি অংশ জানাচ্ছেন, চারতলায় আগে অন্য অফিস ছিল। তারা সরে যাওয়ায় দেবাঞ্জন সেখানে ভাড়াটে হিসেবে আসে। বিল্ডিংয়ের অন্যদের কাছে দেবাঞ্জনের পরিচয় ছিল পুরসভার পদস্থ কর্তা হিসেবে। বিল্ডিংয়ের নীচে তার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। বিকেল সাড়ে ৩টে-৪টে নাগাদ নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে সে গাড়িতে উঠে পড়ত। সঙ্গে থাকত ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। কর্মীদের অনেকে এ-ও জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে জল বা অন্য কোনও সমস্যা হলে তাঁরা ওই বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকারকে তা জানাতেন। তবে দেবাঞ্জনের অফিস থেকে কখনও কাউকে আসতে তাঁরা দেখেননি।
আর এক ভাড়াটের বক্তব্য, ‘‘মাঝেমধ্যেই দেখতাম অনেক লোক আসছেন। শুনতাম, ওই অফিসে ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। এক দিন দেখলাম, বাইরে পর্যন্ত লাইন চলে গিয়েছে। জানতে পারি, প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে। তার পরে শুনি এই কাণ্ড!’’ এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে সারদা গোষ্ঠী-পুরসভার যোগ নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি। ২০১৫ সালে বেহালার একই ঠিকানায় কী ভাবে সারদা গোষ্ঠীর ৪৩টি সংস্থার নামে পুরসভা ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এ বার দেবাঞ্জন-কাণ্ডেও একই বিতর্ক তৈরি হল বলে মনে করছেন অনেকে।