যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, খরচ হওয়া জলের পুরোটাই কলের জল বা পরিশোধিত জল। ফলে এই পরিমাণ জল পরিশোধনে ব্যয় হওয়া টাকার হিসাব বার করলে হয়তো বোঝা যাবে অপচয়ের বহর! তপনবাবুর কথায়, ‘‘তবে এ সব নিয়ে আর ভাবে কে? দেওয়ালে যত ক্ষণ পিঠ না ঠেকছে আমাদের, তত ক্ষণ এ ভাবেই চলবে।’’
রাঙিয়ে দিয়ে যাও: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রং খেলায় মেতেছেন পড়ুয়ারা। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
দোল রঙের উৎসব ঠিকই। কিন্তু এই উৎসব কি জল অপচয়ের অবাধ অনুমোদনেরও?
এই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়েছে এমন একটি সময়ে, যখন ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পটনা, চণ্ডীগড়, দিল্লি, পুণে, ইন্দোর, নাসিক, চেন্নাই-সহ দেশের ১৮.৭ শতাংশ ‘আর্বান লোকাল বডি’-তে (ইউএলবি) জলসঙ্কট রয়েছে। সেখানে আজ, দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ জল খরচ হবে, তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, দোলে ত্বক ও চোখে রঙের প্রভাব, সতর্ক হয়ে রং খেলা নিয়ে প্রতি বছর প্রচার হলেও পুরোপুরি ব্রাত্য থেকে যায় উৎসবে জল অপচয়ের বিষয়টি। অথচ, একাধিক রিপোর্টে কলকাতাকে অদূর ভবিষ্যতে ‘ওয়াটার স্ট্রেসড সিটি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তথ্য বলছে, মাথাপিছু জল পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে কলকাতা শীর্ষে রয়েছে। তাই বলে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে জলের অপচয়ের বিলাসিতা দেখানো যেতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের অধিকর্তা পঙ্কজকুমার রায় জানাচ্ছেন, দোলের সময়ে বেলুনে রঙিন জল ভরা, পিচকারি দিয়ে জল ছেটানো, আবার বালতিতে রং গুলে অন্যের গায়ে ঢালা, এমন হাজার প্রয়োজনে এক বার কল খুললেই গড়ে মাথাপিছু ১০ লিটার জল খরচ হয়, পাঁচ বার কল খুললে খরচ হয় ৫০ লিটার। পঙ্কজবাবুর কথায়, ‘‘শহরের মোট জনসংখ্যার মধ্যে এক লক্ষ লোকও দোল খেললে, শুধুমাত্র দোলের দিনেই অতিরিক্ত জল খরচ হবে ৫০ লক্ষ লিটার! জলসঙ্কটের সময়ে এই অপচয় দুর্ভাগ্যজনক, অবিশ্বাস্য! মনে রাখা দরকার, দোল রঙের উৎসব, জল অপচয়ের লাইসেন্স নয়।’’
বিশেষজ্ঞদের একাংশ আবার জানাচ্ছেন, শুধু দোল খেলাকালীনই নয়, খেলার পরেও জল খরচের পরিমাণ বেড়ে যায়। কারণ, গা থেকে রং তুলতে বা রং লাগা জামাকাপড় কাচতে সাধারণ দিনের থেকে কয়েক গুণ বেশি জল খরচ হয়। যা জলের সার্বিক খরচকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অতীতের রিপোর্ট অনুযায়ী, মাথাপিছু সরবরাহকৃত জলের মধ্যে স্নানে খরচ হয় ৫৫ লিটার, কাচতে ২০ লিটার, অর্থাৎ মোট ৭৫ লিটার। শৌচাগার, বাড়ি ও জিনিস পরিষ্কারের জন্য গড়ে ৫০ লিটার এবং রান্না-পানের জল মিলিয়ে আরও ১০ লিটার। ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা অরুণাভ মজুমদার বলছেন, ‘‘এমনি দিনে স্নান এবং জামাকাপড় কাচতে যে পরিমাণ জল খরচ হয়, দোলের দিন স্বাভাবিক ভাবেই তার থেকে গড়ে তিন গুণ বেশি জল খরচ হয় ধরা যেতে পারে।’’ অর্থাৎ স্নান, কাচা মিলিয়ে মাথাপিছু ২২৫ লিটার! দোলে অংশগ্রহণকারী এক লক্ষ লোক রং খেলা চলাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে যত জল খরচ করেন, তার পরিমাণ ২ কোটি ৭৫ লক্ষ লিটার! খরচ হওয়া এই জলের পুরোটাই দৈনন্দিন হিসাবের বাইরে, অর্থাৎ অতিরিক্ত খরচ।
যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, খরচ হওয়া জলের পুরোটাই কলের জল বা পরিশোধিত জল। ফলে এই পরিমাণ জল পরিশোধনে ব্যয় হওয়া টাকার হিসাব বার করলে হয়তো বোঝা যাবে অপচয়ের বহর! তপনবাবুর কথায়, ‘‘তবে এ সব নিয়ে আর ভাবে কে? দেওয়ালে যত ক্ষণ পিঠ না ঠেকছে আমাদের, তত ক্ষণ এ ভাবেই চলবে।’’
তাই এ বারও হয়তো রঙের উৎসবে জলের অপচয় চলতেই থাকবে। যেমনটা প্রতি বছর হয়ে এসেছে!