ফিরহাদ হাকিম। ফাইল চিত্র।
কলকাতা পুরসভা ভবনে মেয়রের যে চেয়ার, ঠিক তার পিছনেই সার দিয়ে রয়েছে একাধিক মনীষীর ছবি, যাঁরা ওই চেয়ারে বসেছেন। দেশবন্ধু, নেতাজি, বিধানচন্দ্র রায়— ছবিগুলি এমন ভাবে রাখা, যেন মনে হয়, তাঁরা উপর থেকে মেয়রকে নজরে রাখছেন। এই যে চেতলার বাড়িতে বসে আনন্দবাজারের জন্য এ কথা লিখছি, এখনও তা মনে করে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কলকাতার মেয়র পদের দায়িত্ব এখনও আমার কাছে কিছুটা এমনই। ২০১৮ সালে যখন এই দায়িত্ব নিলাম, তখন থেকেই এই ভাবনা ওই চেয়ারে আমাকে টানটান বসিয়ে রেখেছে। তাই আমার মেয়রগিরি বলে সে অর্থে কিছু নেই। ওই ওঁদের অদৃশ্য পাদুকা রেখে কাজ করার মতোই।
আমি তো এই চেয়ারে আচমকা এসে পড়লাম। একটা টানাপড়েনের মধ্যে শোভন হঠাৎ পদত্যাগ করে বসল। আমি তখন নবান্নে। অনেকের মতোই খবরটা পেয়েছি। সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে হঠাৎ মমতাদি ঘরে ডাকলেন। বললেন, ‘ববি, শুনেছিস তো! তোকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কাউন্সিলর আমি অনেক আগে থেকে। মেয়র পারিষদ, বরো চেয়ারম্যান— এ সব কাজও দেখেছি, করেছি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই শহরের গোটা পরিষেবা-প্রশাসনের কথা ভেবে ভয় হচ্ছিল। তাই গোড়া থেকেই সতর্ক ছিলাম। যেখানে যা জানতাম না বা বুঝতাম না, সেখানে সশরীরে পৌঁছে যেতাম। দাঁড়িয়ে দেখতাম সব।
কলকাতায় কাজ তো অনেক হয়েছে। আগে তো বটেই, পরেও বাম ও তৃণমূল পুরবোর্ডের আমলে যে কাজ শুরু হয়েছিল, তা এগিয়েছে। তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আর মমতাদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে রাজ্য সরকারের বহু প্রকল্প সরাসরি পুর পরিষেবারই অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বিল্ডিং বিভাগের বেআইনি বাড়িকে আইনি করার ব্যবস্থাটা তুলে দিই। ওই কাজের জন্য ডিজি-২ পদটার কোনও দরকারই ছিল না। তাতে কিছুটা কাজ হয়েছে। ১৫ দিনে বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা এখনও পুরোপুরি পারিনি। তবে মানুষের অনন্তকালের অপেক্ষা কমাতে পেরেছি।
আরও একটা কাজ জরুরি ছিল। কাউন্সিলরকে যেমন ওয়ার্ডের মানুষ সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন, ভেবেছিলাম, মেয়রের ক্ষেত্রেও তেমন একটা চেষ্টা করা যায়। শুরু করেছি। ফোনে ব্যবস্থা হয়েছে। ‘টক টু মেয়র’ চলছে। অনেকেই ফোন করছেন। অভাব, অভিযোগ জানাচ্ছেন। সব করতে পারছি, তা নয়। তবে চেষ্টা করছি। জল, কল ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়মিত ভাবে পালনের চেষ্টা করছি। কলকাতায় এই পরিষেবা ক্রমশ ভাল হয়েছে। সবই ‘টিমওয়ার্ক’। পুরসভার ‘টিম’ হিসাবে সাফল্য পেয়েছি আমরা।
রাজনীতিতে অনেক কিছু দেখেছি, শিখেছি, করেছি। ভেবে দেখেছি, সে সব অভিজ্ঞতা খুব ব্যতিক্রমী নয়। তবে মেয়র পদে বসায় একটা আলাদা জীবনবোধ আমাকে স্পর্শ করেছে। আমার এই ভাঙা মেয়াদকালে করোনা অতিমারি, আর তার জন্য একেবারে অপরিচিত এক ব্যবস্থা, লকডাউনের মোকাবিলা করতে হয়েছে মানুষকে। কোনও ধারণাই ছিল না এমন পরিস্থিতি নিয়ে। মনে পড়ে, এক সময়ে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছিল। হাসপাতালে, বাড়িতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুভীতি অনেককেই গ্রাস করে নিচ্ছিল। শ্মশানগুলিতে সৎকারের কাজে বাধা আসতে থাকায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হল। একে তো মৃত্যুর ঘটনায় শোক, হতাশা। তার উপরে দাহকাজে বাধা। এক সময়ে প্রায় ৩০০ দেহ আটকে গেল। অসহায় লাগছিল। কিন্তু কাউকে তা বলিনি। দেখলাম, মমতাদিও নেমে পড়েছেন। মানুষকে সাহস ও পরামর্শ দিতে ঘুরছেন। আমিও নামলাম। শ্মশানে শ্মশানে গিয়ে কথা বলে, বুঝিয়ে বাধা কাটানো গেল। ধাপাতেও পরিকাঠামো বাড়ানো হল। আতঙ্কে বসে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্স ও শববাহী গাড়ির চালকদের আবার স্টিয়ারিংয়ে তোলা হল। পরে ওঁরাই কলকাতার মানুষের সহায় হয়ে ওঠেন।
এখন ভাবি, কোন সময়টা পেরিয়ে আসতে পেরেছি আমরা! তখন ‘নাইসেড’ আমার কাছে জানতে চাইল, এ শহরে করোনার প্রথম প্রতিষেধক নিতে আমি রাজি কি না। আমার সুগার নেই। আমি নিলে ভয় কাটিয়ে আরও মানুষ প্রতিষেধক নেবেন। ভেবেছিলাম, এটা কোনও ঝুঁকি নয়, বরং একটা সুযোগ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। কাউকে কিছু না বলেই রাজি হয়ে গেলাম। প্রতিষেধক নিলাম। বাড়িতে জানল, টিভি দেখে। মমতাদিকেও বলিনি। পরে প্রতিষেধকের লাইনে ভিড় দেখে তৃপ্তি পেয়েছি।
পরিষেবার কাজ কখনও শেষ হয় না। রাস্তা, জল, কল, নিকাশি, স্বাস্থ্য— এ সব চিরদিন থাকবে। কিন্তু করোনা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। শিখিয়েছে, মেয়র হওয়া মানে পদে থাকা নয়, পথে নামা। এই দায়িত্ব আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। জীবনে বারংবার এমন পরিস্থিতি আসে না, ঠিক। কিন্তু এলে যে রাস্তা পেরোতে হয়, তা-ও এক গভীর শিক্ষা। চোখ বুজে ভাবলে একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। মানুষের নির্ভরতার মূল্য দিতে পারার জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে মন চায়।