অনটনেই কি চরম সিদ্ধান্ত বৃদ্ধ দম্পতির

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, পারিবারিক অশান্তি বহু দিনের। পৃথ্বীশের কোনও চাকরি নেই। পরিবার মূলত চলে পৃথ্বীশের স্ত্রী দেবলীনার টাকায়। তিনি তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। নরেন্দ্রপুরের ফ্ল্যাটে একসঙ্গে থাকলেও তাঁদের হেঁসেল আলাদা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:৫২
Share:

আত্মঘাতী বৃদ্ধ পীযূষ মজুমদার।

পরিকল্পনা করে বৃদ্ধ দম্পতির গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার পিছনে প্রাথমিক ভাবে পারিবারিক অশান্তির ছায়াই দেখতে পাচ্ছে পুলিশ। শনিবার ওই বৃদ্ধ দম্পতি মাঝ গঙ্গায় লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মারা যান বৃদ্ধ। বৃদ্ধা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।

Advertisement

শনিবার তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি। মোবাইল ভিজে গিয়েছিল। রবিবার অবশেষে সেই সিম কার্ড থেকেই পাওয়া যায় বৃদ্ধের ভায়রাভাই গোবিন্দ কুণ্ডুর ফোন নম্বর। তাঁর সঙ্গে কথা বলেই পুলিশ জানতে পারে, মৃত বৃদ্ধের নাম পীযূষ মজুমদার (৭৮)। সোনারপুর থানা এলাকার নরেন্দ্রপুরের কাছে একটি আবাসনে ছেলে-বৌমা-নাতির সঙ্গে থাকতেন ওই দম্পতি। রবিবার সকালে খবর পেয়ে পীযূষবাবুর ছেলে পৃথ্বীশ হাওড়া থানায় যান। সঙ্গে যান গোবিন্দবাবু। এ দিন ময়না-তদন্তের পরে পীযূষবাবুর দেহ নিয়ে তাঁরা সৎকারের জন্য চলে যান। তার আগে পৃথ্বীশ অসুস্থ মাকে দেখে আসেন বলে জানান তিনি নিজেই।
পৃথ্বীশের মা হাওড়া হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, পারিবারিক অশান্তি বহু দিনের। পৃথ্বীশের কোনও চাকরি নেই। পরিবার মূলত চলে পৃথ্বীশের স্ত্রী দেবলীনার টাকায়। তিনি তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। নরেন্দ্রপুরের ফ্ল্যাটে একসঙ্গে থাকলেও তাঁদের হেঁসেল আলাদা। এ দিন পৃথ্বীশ জানান, আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সেই কারণে মানসিক অবসাদেও ভুগছিলেন তাঁর বাবা-মা। তাঁর ধারণা, সেই অবসাদের জেরেই এমন ঘটনা।

Advertisement

পীযূষবাবু এক সময়ে জেসপে চাকরি করতেন। তেঘরিয়ায় থাকতেন। জেসপ বন্ধ হয়ে গেলে চাকরি চলে যায় তাঁর। পৃথ্বীশ তখন ছোটখাটো চাকরি করতেন। পৃথ্বীশের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তেঘরিয়ায় একটি ফ্ল্যাটও কেনেন তাঁরা। এ দিন পুলিশ ও নরেন্দ্রপুরের পড়শিদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর দেড়েক আগে তেঘরিয়ার ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্রপুরে চলে আসেন দেবলীনারা। এ দিন দেবলীনা বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে নরেন্দ্রপুরে পড়ানোর জন্যই আমরা তেঘরিয়া ছেড়ে চলে আসি। আমার শাশুড়ির বহু দিনের মানসিক সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসাও হয়েছে। শ্বশুর ও শাশুড়ি দু’জনেই অবসাদে ভুগতেন। ছেলে চাকরি করে না, অবসাদের মূল কারণ সেটাই।’’ তবে প্রতিবেশীদের একাংশের অভিযোগ, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না দেবলীনার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘পারিবারিক এই অশান্তির মাঝে পৃথ্বীশের বিশেষ কিছু বলার থাকত না। তিনি চাকরি করতেন না। মাস দুয়েক আগে পীযূষবাবুই এসে আমাদের কাছে ছেলের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই সময়ে আমরা পারিবারিক এই অশান্তির কথা জানতে পারি। গত রবিবারও পীযূষবাবু এসে দেবলীনার নামে অভিযোগ করেন। বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। একটু সময় দরকার। আপনারা একটু বোঝান না।’ পৃথ্বীশকে ডেকে আমরা কথাও বলি।’’ যদিও পড়শিদের দাবি, তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। অভিযোগ, অশান্তি চলতেই থাকে।


এই আবাসনেই ভাড়া থাকতেন আত্মঘাতী বৃদ্ধ। রবিবার, নরেন্দ্রপুরে। নিজস্ব চিত্র

মাস দুয়েক আগে পীযূষবাবুর স্ত্রীর সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়। দেবলীনাই এ দিন জানান, সেই সময়ে হাসপাতালে রাখার ৪৮ হাজার টাকা তাঁকেই দিতে হয়েছে। প্রতিবেশীদের দাবি, হাসপাতালে অত টাকার খরচ বহন করতে না পেরে শেষে পীযূষবাবু স্ত্রীকে সুন্দরবনের কাছে একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে দেড় মাস ভর্তি ছিলেন তিনি। পড়শিরা জানিয়েছেন, পীযুষবাবুদের আর্থিক কষ্ট এতটাই চরম হয়ে গিয়েছিল যে মাসে এক বার করে তেঘরিয়ায় গিয়ে কোনও ‘সহৃদয়’ ব্যক্তির কাছ থেকে গোটা মাসের চাল-ডাল-মশলা নিয়ে আসতে হতো তাঁকে। তা কিনে নেওয়ার মতো উপায় ছিল না তাঁদের।

সম্প্রতি পৃথ্বীশ রাঁচিতে একটি চাকরি পেয়েছেন বলে এ দিন দেবলীনা জানান। রবিবারই সেই চাকরিতে যোগ দিতে যাওয়ার কথা ছিল। দেবলীনার অভিযোগ, তার আগেই শনিবার পৃথ্বীশের বাবা-মা বেরিয়ে যান পৃথ্বীশের মাসির বাড়ি যাচ্ছেন বলে। মাসি অনেক দিন আগে মারা গিয়েছেন। মেসো গোবিন্দবাবু গিরিশ পার্কে থাকেন। তাঁরা বলে যান, শনিবার রাতে গিরিশ পার্কেই থাকবেন তাঁরা। তাই শনিবার রাতে তাঁরা বাড়ি না ফেরায় কোনও খোঁজ করেননি ছেলে-বৌমা। রবিবার সকালে খবরের কাগজে পীযূষবাবুর ছবি বেরোনোর পরে খবর পান দেবলীনারা। এর পরে তাঁরাই যোগাযোগ করেন পুলিশের সঙ্গে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement