যাত্রা: আলোকোজ্জ্বল রেড রোডের দুর্গাপুজো কার্নিভালে পর পর চলেছে প্রতিমা। শনিবার সন্ধ্যায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
আদিবাসী লোকনৃত্য থেকে রাজস্থান, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশের নৃত্যকলায় রেড রোড তখন হয়ে উঠেছে জমকালো ফিল্ম সিটি। দক্ষিণ কলকাতার এক পুজোকর্তা বলে উঠলেন, ‘‘সবই হল, টিভি-তে ছবি দেখাল, কিন্তু পুজোয়ভাসানের আনন্দটা কেমন পাল্টে গেল। পাড়ার বয়স্কদের সবাইকে আনতে পারিনি! ঠাকুরের সঙ্গে কিছু নাচ-গানের ব্যবস্থা না-করলে মুখ থাকবে? এর জন্য তো ইভেন্টের লোকজনকেই ডাকতে হবে।’’
অনেকেই বলছেন, আজকের কলকাতার পুজো হয়তো শিল্পের উৎকর্ষে ভাল নম্বর পাচ্ছে। কিন্তু পুজোর থিম তৈরি থেকে শুরু করে মণ্ডপের ভিড় সামলানোর কাজে বাইরের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাই ভরসা। পাড়ার পুজো আর পাড়ার নেই। সবই যে ‘আউটসোর্স’ হয়ে গেল, তা কলকাতায় প্রায় দিন পনেরো ধরে চলা দুর্গোৎসবের শেষ বিন্দু, কার্নিভালে এসেও পরিষ্কার। বেহালার নূতন দল কার্নিভালের নাচগানের আয়োজনে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের সাহায্য নিয়েছে। হাতিবাগান সর্বজনীনের শোভাযাত্রায় বাংলার লোকসংস্কৃতি তথা পটশিল্পের সম্ভার মেলে ধরার পাশাপাশি নাচগানের শিল্পীরাও ছিলেন। তাঁরা দমদম থেকে যোগ দেন। নূতন দলের পুজোকর্তা সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সে তো মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলও বহু দিনই বিদেশি খেলোয়াড় খেলাচ্ছে। পুজোয় বা পুজোর কার্নিভালে সবাইকেই পাড়ার লোক হতে হবে, এ কেমন কথা! বাইরের শিল্পীদের দিয়ে নাচ, গান করালে মোটেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’’ তবে, অনেক মধ্যবিত্ত পুজোর জন্য কার্নিভালের ঝক্কি যে এক ধরনের আর্থিক চাপ, সেটাও বলছেন পুজোকর্তারাই। সন্দীপনের হিসাব, ‘‘যে কোনও পুজোরই বিসর্জনের একটা খরচ আগেও থাকত। কার্নিভালের জন্য সেটা অবশ্যই বেড়েছে। খুব বেশি আয়োজন না-করলেও নাচ, গান, বাজনা মিলিয়ে এই অঙ্কটা কম করে লাখখানেক হবে। বড় বাজেটের পুজোর ক্ষেত্রে খরচটা আরও বেশি।’’
পুলিশ এ বার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল, শোভাযাত্রায় এক-একটি পুজো ৬০ জনের বেশি লোক নিয়ে আসতে পারবে না। থাকবে সর্বাধিক তিনটে ট্রেলার। তবে সেই নিয়ম মোটেও সবার পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হয়নি। হাতিবাগান সর্বজনীনের কর্তা তথা বিভিন্ন বারোয়ারি পুজোর মঞ্চ ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের সম্পাদক শাশ্বত বসুই বলছেন, ‘‘সবাইকেই অল্পবিস্তর মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে হয়েছে।’’
কার্নিভালের নানা জৌলুসেও কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন খচখচ করছে। ঠাকুর বা থিমের ট্যাবলো মুখ্যমন্ত্রী এবং গণ্যমান্য অতিথিদের সামনে মেলে ধরা হলেও পুজো আর প্রতিমার আসল রূপকার শিল্পীদের আরও একটুপুরোভাগে রাখা যেত, এমনটা মনে করছেন অনেকেই। পুজো প্রতিযোগিতার বিশিষ্ট বিচারক তথা কিশোর বয়স থেকে কলকাতার পুজোর সঙ্গে যুক্ত ভাস্কর বিমল কুণ্ডুই কিছুটা ক্ষুণ্ণ। তিনি বলছেন, ‘‘বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে চিত্রতারকা, নেতা, মন্ত্রীদের দেখতে ভালই লাগে। আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ একটু থাকতে পারত।’’ তারকা থিম শিল্পীদের মধ্যে সুশান্ত পাল অবশ্য কার্নিভালে শামিল তাঁর দু’টি পুজো টালা প্রত্যয় এবং যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লির সঙ্গে হেঁটেছেন। তবে কার্নিভালের বিষয়ে কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিলেও বাগুইআটির অর্জুনপুর আমরা সবাইয়ের সঙ্গে ছিলেন না ভবতোষ সুতার। কার্নিভালে শিল্পীদের সম্মাননা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘এখানে তো খালি তৃণমূল বিজেপিকে বা বিজেপি তৃণমূলকে ডাকল কি না, তা নিয়েই আলোচনা হয়! অন্য কথা আর কী বলব!’’
তবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে বসেছিলেন, সেই মঞ্চেই দেখা যায় ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতাকে। ইউনেস্কোর কাছে কলকাতার দুর্গাপুজোর স্বীকৃতির পিছনে তাঁরও কিছুটা ভূমিকা ছিল। কার্নিভালে কিছু ক্ষণ ছিলেন তপতী।