কলকাতা বিমানবন্দরে আটক ড্রোন পরীক্ষা করে দেখছেন আধিকারিকরা।—নিজস্ব চিত্র।
ফ্রান্স থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছিল চারটি ড্রোন। কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতর (কাস্টমস)-এর হাতে আটক হওয়া ওই ‘নজরদারি ড্রোন’গুলি নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। চিনে ‘অ্যাসেম্বল্ড’ হওয়া ওই ড্রোনগুলি কলকাতার যে সংস্থা আমদানি করেছিল, তাদের প্রতিনিধি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি লাইসেন্স দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই লাইসেন্স আদৌ বৈধ কি না, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) সূত্রে খবর, ফ্রান্সের ‘প্যারট’ কোম্পানির তৈরি এএনএএফআই ব্র্যান্ডের চারটি ড্রোন গত ২৩ সেপ্টেম্বর এসে পৌঁছয় কলকাতা বিমানবন্দরে। মাস দুয়েক আগেও ছ’টি ড্রোন এসেছিল কলকাতায়। সেই ড্রোনগুলির নথি ভাল ভাবে খতিয়ে না দেখেই ছে়ড়ে দেওয়া হয়। পরে তা নিয়ে সমস্যাও তৈরি হয়। তাই এ বারের ড্রোনগুলি নিয়ে বেশিই সতর্ক ছিল শুল্ক দফতর। জানা গিয়েছে, এ বারের ড্রোনগুলি প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নজরদারি চালাতে পারে। ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার গতিবেগে উড়তে সক্ষম।
কলকাতা পুলিশ যে ড্রোন ব্যবহার করে, তার বেশির ভাগই ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নজরদারি চালাতে পারে। ফলে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এই ড্রোন কী কারণে আমদানি করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রথমেই সংশয় তৈরি হয় শুল্ক দফতরের।
আরও পড়ুন: হাজরা? কে হাজরা? দিল্লি থেকে কলকাতা, জবাব খুঁজছে গোটা পরিবার
বিমানবন্দর সূত্রে খবর, যে সংস্থা ওই ড্রোনগুলি খাতায়-কলমে আমদানি করেছে সেই ‘মেসার্স ইউএভি সিস্টেমস্ প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। রেজিস্টার অব কোম্পানিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তৈরি ওই কোম্পানির ঠিকানা মহেশতলা-রবীন্দ্রনগর এলাকার বিধানগড়। ওই সংস্থার তরফে আরব খান নামে গার্ডেনরিচের বাসিন্দাকে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হয় শুল্ক-কর্তাদের কাছে। আইবি সূত্রে জানা গিয়েছে, ড্রোন আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় নথি দেখতে চাওয়া হলে আরব খান ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক্সপোর্ট প্রোমোশন সেলের দেওয়া একটি নথি দেখান। ওই লাইসেন্সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক আন্ডার সেক্রেটারি এবং এক উপ-সচিবের সই ও স্ট্যাম্প রয়েছে। নথিতে লেখা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক্সপোর্ট প্রোমোশন সেল কলকাতার ওই সংস্থাকে বিভিন্ন ধরনের ২২টি ড্রোন আমদানি করার অনুমতি দিচ্ছে। ওই নথি অনুযায়ী, আমদানি করা ফরাসি ড্রোন ব্যবহার করবে ভারতীয় সেনা।
নথি দেখেই সন্দেহ হয় শুল্ক দফতরের কর্মী এবং আইবি আধিকারিকদের। কারণ, ভারতের আমদানি-রফতানি আইন অনুযায়ী ড্রোন নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত। বিদেশ থেকে ড্রোন আমদানি করতে ডিরেক্টর জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ) এবং ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড-এর অনুমতি প্রয়োজন। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এ ধরনের জিনিস আমদানি করার লাইসেন্স ইস্যু করতে পারে না। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক্সপোর্ট প্রোমোশন সেল বিদেশে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বিক্রি এবং ক্রেতা খোঁজার কাজ করে। সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই।” শুল্ক দফতরের সন্দেহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই নথি আদৌ বৈধ নয়।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এই নথিই পেশ করেছে আমদানিকারী সংস্থা।
ইতিমধ্যেই ওই নথির বৈধতা সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, ওই নথিতে আমদানিকারী সংস্থার যে ঠিকানা দেওয়া রয়েছে, তাতেও ভুল রয়েছে। তাঁদের দাবি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নথিতে এমন ভুল অবিশ্বাস্য। আইবি সূত্রে খবর, সংস্থার নথিভুক্ত ডিরেক্টর হিসাবে দুই মহিলার নাম রয়েছে। সংস্থার আর্থিক লেনদেনের নথিও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: বিরতি কাটিয়ে ফের শুরু জেলা সফর, চার দিনের জন্য উত্তরবঙ্গে মমতা
সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকদের কাছে গোপন সূত্রে খবর আসে, জাল নথি দিয়ে কয়েকটি ‘ভুয়ো’ কোম্পানি বিদেশ থেকে ড্রোন আমদানি করছে যা জাতীয় নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সেই সূত্র ধরেই জানা যায়, দু’মাস আগে ছ’টি ড্রোন আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু তখন আমদানি সংক্রান্ত নথি ভাল ভাবে খতিয়ে না দেখেই ছে়ড়ে দেওয়া হয় ওই ড্রোনগুলি। পরবর্তী তদন্তে সেই অসতর্কতা প্রকাশ্যে আসায় শুল্ক দফতরের এক আধিকারিককে বিমানবন্দর থেকে সরিয়েও দেওয়া হয়। যদিও শুল্ক দফতরের বিমানবন্দর কমিশনারেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল কমিশনার দীপ শেখর বলেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’’
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা এখন খোঁজার চেষ্টা করছেন, কাদের জন্য ওই ড্রোন আমদানি করা হয়েছে। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘আমদানিকারী সংস্থা যে নথি পেশ করেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় রাইফেলস এবং অসম রেজিমেন্টের উল্লেখ রয়েছে। আমরা সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ করছি।”
কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকে আমদানিকারী সংস্থার যে ইমেল আইডি দেওয়া রয়েছে, সেই আইডি-তে মেল করে সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তাদের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। গোটা বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করে সিবিআই অধিকর্তা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতা অভিজিৎ দাসের। তিনি বলেন, ‘‘একটি সূত্র থেকে এই খবর পেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং সিবিআই অধিকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। কারণ গোটা ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত।”