ভাসমান: অল্প বৃষ্টিতেই বানভাসি সল্টলেক। ফাইল চিত্র।
প্রতি বর্ষার মতো সে দিনও বাড়ির একতলা ডুবেছিল বৃষ্টির জলে। ইনভার্টারেও জল ঢুকে গিয়েছিল। সেই ইনভার্টারের সুইচ বন্ধ করতে গিয়েই বাড়ির লোকের চোখের সামনেই জলে লুটিয়ে পড়েন বছর পঁয়তাল্লিশের রসায়নের অধ্যাপক।
২০১৯ সালের সেই ঘটনা এখনও ভোলেনি বাগুইআটির জ্যাংড়া এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই। বিধাননগর পুরনিগম হওয়া সত্ত্বেও এখনও নিকাশি ব্যবস্থার দৈন্য দশা স্পষ্ট বাগুইআটির বিদ্যাসাগর পল্লি, রবীন্দ্র পল্লি, জ্যাংড়া দক্ষিণ মাঠ, অশ্বিনীনগর, আদর্শ পল্লি, শচীন্দ্রলাল সরণি, সাহাপাড়া, ধানমাঠ, স্কুলপাড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার। রবীন্দ্র পল্লিরই বাসিন্দা ছিলেন ওই অধ্যাপক।
২০১৫ সালে রাজারহাট-গোপালপুর এবং বিধাননগর পুরসভা মিশিয়ে তৈরি হয়েছিল বর্তমান বিধাননগর পুরসভা (পুরনিগম বা কর্পোরেশন)। অভিযোগ, একটা সম্পূর্ণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও বাগুইআটি তল্লাটের ওই সব এলাকার জল জমার রোগ সারেনি। বরং চলতি বছরে বিধাননগর পুর এলাকার সল্টলেকে কেষ্টপুর খাল লাগোয়া ব্লকগুলির বিভিন্ন বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। কারণ, কেষ্টপুর খাল পলি জমে নাব্যতা হারিয়েছে। বাসিন্দারাই জানিয়েছেন, দু’-তিন মাস আগের ওই ভারী বৃষ্টিতে অনেক বাড়িতেই ভূগর্ভস্থ জলাধারে মিশে গিয়েছিল নিকাশির জল। কেষ্টপুর খালের জল স্বাভাবিক গতিতে বয়ে না গিয়ে ঠেলে উল্টো মুখে সল্টলেকের খাল লাগোয়া বাড়িগুলিতে ঢুকে গিয়েছিল। কেষ্টপুর এবং বাগজোলা খালে পলি জমার অন্যতম কারণ খালের উপরের বেআইনি দখলদার। আজ পর্যন্তযাঁদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি।
এ সব নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, জল জমার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই কোঅর্ডিনেটর কিংবা পুর কর্তৃপক্ষ খালের নাব্যতার যুক্তি দেখান। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘পুরসভারও দায়িত্ব প্রশাসনের। খালও প্রশাসনের। তবে কেন সময় মতো খাল কাটা হবে না?’’
বিধাননগর পুর এলাকার নিকাশির দু’টি ধমনী কেষ্টপুর এবং বাগজোলা খাল। সল্টলেকের নিকাশি ব্যবস্থা অনেকটাই নির্ভরশীল কেষ্টপুর খালের উপরে। অন্য
দিকে বাগজোলার উপর নির্ভর করে রাজারহাট-গোপালপুর এলাকা। বাগুইআটি এলাকার জল বাগজোলায় গিয়ে পড়ে বাগজোলা বাইপাস (বিবি-১) খাল দিয়ে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পলি জমে চরম দুদর্শাগ্রস্ত অবস্থা সেই খালটিরও।
মধ্যমগ্রামে আয়োজিত সাম্প্রতিক প্রশাসনিক বৈঠকে রাজারহাট-গোপালপুরের তৃণমূল বিধায়িকা অদিতি মুন্সীও এই সব জায়গায় জল জমার সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। ঝাঁ চকচকে চিনার পার্ক, হলদিরাম এলাকা সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায়। ওখান দিয়ে অনেকগুলি এলাকার জল বাগজোলা খালে গিয়ে পড়ে। কিন্তু দুর্বল নিকাশি ব্যবস্থার কারণেই জল জমে থাকে চিনার পার্ক-সহ আশপাশে।
সম্প্রতি চিনার পার্ক এলাকায় ২০০ কিউসেক জল বার করার একটি পাম্প হাউসের শিলান্যাস হয়েছে। যেটি তৈরি করছে হিডকো। অন্য দিকে কেষ্টপুরের কাছে হরিচাঁদ পল্লিতেও একটি জল নিকাশির পাম্প হাউসের শিলান্যাস করা হয়েছে। সেটি তৈরি করার কথা সেচ দফতরের। বিবি-১ খালের মুখেও একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসানোর কথা ভাবা হয়েছে। পুরসভার দাবি, ওই দু’টি প্রকল্প শেষ হলে মানুষ জমা জলের যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পাবেন। বাসিন্দাদের দাবি, এ যেন খেলা শেষ হওয়ার পরে গা ঘামাতে নামা।
বিধাননগর পুরসভার অন্দরের খবর, ২০১৫ সালে তৈরি ওই নতুন পুরনিগমের বোর্ডে বহু উন্নয়নমূলক কাজকর্ম আটকে গিয়েছে শুধুমাত্র দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সব ব্যাপারে হস্তক্ষেপের কারণে। বর্তমান বোর্ডের কাছে তাই প্রচারের পুঁজি বলতে লক্ষ্মীর ভান্ডার, দুয়ারে সরকার কিংবা করোনার টিকা নিয়ে নিজেদের খতিয়ান। এক প্রাক্তন আধিকারিকের কথায়, ‘‘নতুন পুর বোর্ডের শুরুর দিকে এই পুরসভা ইঞ্জিনিয়ারদের মশা মারতে এবং রাস্তায় বেআইনি দখলদার তুলতে পাঠাত। কারিগরি কাজের পরিকল্পনা আসবে কোথা থেকে?’’
সেই পরিস্থিতি খানিকটা বদলেছে। পুরসভার আধিকারিকদের একাংশ জানিয়েছেন, বর্তমানে কারিগরি কাজকর্মের পরিকল্পনায় ইঞ্জিনিয়ার এবং অফিসারদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি নিকাশি-সহ বিধাননগরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের রূপরেখা তৈরি করতে রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে নবান্নে গিয়েছিলেন পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার ও আধিকারিকেরা। নিকাশি সম্পর্কিত একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব হল, সবটাই বাস্তবায়িত হওয়ার কথা পরবর্তী বোর্ড তৈরির পরেই।
যদিও বিধাননগরের প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর দাবি, জানুয়ারি থেকে খাল সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, ‘‘নগরায়ণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সময় লাগে। কারণ অনেক ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করতে হয়। দু’টি পাম্প হাউসের শিলান্যাস হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মধ্যমগ্রামে জল নিকাশির সমস্যা নিয়ে দরবার করার পরেই, ওই দু’টি পাম্প হাউসের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। নর্দমার সাফাই নিয়মিত হচ্ছে।’’
যদিও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাসের দাবি, বাগজোলা, কেষ্টপুর-সহ বহু খালের সংস্কার বাম আমলের পরে হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘খোলা নর্দমা ঢাকা দিয়ে দেওয়ায় পলি সংস্কার হয়নি। বাগুইআটি তো বটেই, সল্টলেকও এখন জলে ভাসে। এই সমস্যা গত দশ বছরে অনেক বেড়েছে। এ সব নিয়ে প্রচার করব।’’