প্রতীকী চিত্র।
বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না এই ভয়েই আত্মহত্যা করল একটা ১৩ বছরের মেয়ে! এই ঘটনায় অনেকেই হয়তো বাবা মায়ের দোষ দেখবেন। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাটাই তো স্বাভাবিক। সমস্যাটা হচ্ছে, স্বপ্ন যখন চাপ তৈরি করে তখন আর মানুষ তার থেকে উৎসাহ নাও পেতে পারে। বরং আসতে পারে উদ্বেগ। আর তার থেকে আসতে পারে এমন চরম সিদ্ধান্ত।
বাবা বা মায়ের স্বপ্ন দেখানো অনেককেই উৎসাহ দেয়। সেটা ভাল। কিন্তু মনে রাখতে হবে উৎসাহ দিতে গিয়ে যেন সন্তানের মনের মধ্যে এটা ঢুকিয়ে দেওয়া না হয় যে, এটাই সাফল্যের একমাত্র পথ। আর সেই ভাবনা একটা চাপ তৈরি করতে থাকে। যেটা বাইরে থেকে অনেক সময়ে বোঝা যায় না। কিন্তু সেই খানেই আমাদের সন্তানের সঙ্গে সহমর্মী সংলাপের সেতু নির্মাণের প্রয়োজন। বেশি প্রত্যাশা কিন্তু ব্যর্থতার আশঙ্কা তৈরি করে। আজ আমহার্স্ট স্ট্রিটের যে ঘটনা তাতে ব্যর্থতার আশঙ্কা থেকেই ব্যর্থতার ভাবনা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
যে বয়সের মেয়েটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কাছে আইপিএস কী সেটা ভাল করে জানারও কথা নয়। কিন্তু হয়তো ওর মনের মধ্যে এই ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, এই স্বপ্ন পূরণ না হলে ও বাবাকে খুশি করতে পারবে না। হয়তো ভেবেছিল, আমি যদি আইপিএস না হতে পারি তবে হয়তো বাবা মায়ের সুযোগ্য সন্তান হওয়া হবে না। আমার জন্যই ওদের সারা জীবন খারাপ থাকতে হবে। এমন চিন্তা আসতেই পারে ওই মেয়েটির মনে। সেখান থেকেই নিজেকে আগাম দায়ী করার প্রবণতা আসতে পারে। এক ধরনের অপরাধবোধও আসতে পারে।
আরও পড়ুন: প্রণব-স্মরণে সভা শুভেন্দুর, মুখেই আনলেন না তৃণমূলের নাম
সাধারণ ভাবে এই ধরনের ঘটনায় পরিবারের দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু আমি মনে করি সেটা ঠিক কাজ নয়। বরং, আমাদের আত্মনিরীক্ষণ দরকার। মনে রাখতে হবে বাবা মায়ের স্বপ্নের ভার যেন সন্তানের উপরে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এটাও মনে রাখতে হবে জীবনকে সাফল্য আর ব্যর্থতার মাপকাঠিতে দেখলে চলবে না। আবার সেই সাফল্য বা ব্যর্থতা মোটেও একটা পরীক্ষার উপরে নির্ভর করতে পারে না। এই সঙ্কুচিত ভাবনা, একমুখী চিন্তা অবসাদ তৈরি করতে পারে। এটা নিয়ে সজাগ থাকা দরকার।
শুধু যে বাবার স্বপ্ন তা নয়। এ ক্ষেত্রে বাবা নিচুতলার পুলিশকর্মী। এমনটাও হতে পারে যে বাবাকে আইপিএস অফিসারদের স্যালুট করতে হয় দেখে মেয়ের মধ্যেও হয়তো তৈরি হয়েছিল এক স্বপ্ন। পরিবারের মধ্যেও অনেক সময়ে এই রকম আলোচনা হয় যে, এক দিন আইপিএস অফিসার হয়ে বাবার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবে মেয়ে। সেটাও সবার অগোচরে এক প্রত্যাশার জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। আর সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে যে ব্যর্থতা আসবে তার আশঙ্কাই চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে হয়তো।
একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, সন্তানের মধ্যে অবসাদ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে কথাবলা দরকার। খোলাখুলি কথা বলে তার মন বুঝতে হবে। জানতে হবে হবে তার মধ্যে কেন অবসাদ আসছে, কেন উদ্বেগ আসছে বা আদৌ মৃত্যু চিন্তা আসছে কি না। সেটা জেনে প্রয়োজন হলে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শও নিতে হবে। কিন্তু সবার আগে কাজটা করতে হবে পরিবারের লোকেদের। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ছোট থেকেই বোঝাতে হবে জীবন শুধু কিছু পরীক্ষায় সাফল্য বা ব্যর্থতার উপরে নির্ভর করে না। বলতে হবে, যেমন খুশি, যা মন চায় তাই করে সফল হতে হবে। আর তুমি যেমনই হও তুমি আমাদের ভালবাসা পাবে। আর তাতেই আমরা সুখী হব। কেউ জানে না কে কোন পথে সফল হবে।
আরও পড়ুন: আইপিএস হতে হবে! মানসিক চাপে শহরে আত্মঘাতী সেভেনের ছাত্রী
পুলিশ বাবার মেয়েকে পুলিশের উঁচু পদেই যেতে হবে এটা ঠিক নয়। নির্দিষ্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটাই একমাত্র সাফল্য এটা ঠিক নয়। জীবনে সফল হওয়ার এই মাপকাঠি ভিন্ন ভিন্ন হতে পার। অনেক কিছু করেও সফল হওয়া যায়। কেউ এক জন ব্যবসা করে বা রাজনীতি করেও জীবনে সফল হতে পারে। শেখাতে হবে, কোনও কাজই ছোট নয়। নীচু, উঁচু এই নির্মাণগুলোও ভাঙা দরকার। যে সন্তান ভাবছে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ না হলে তাঁরা সুখী হবেন না, তাদের বোঝাতে হবে তুমি না থাকলেও কি আমরা সুখী হতে পারব?