নিজের বাড়ির দরজা বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলো জ্বালানোর কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে সামাজিক দূরত্বের বালাই না রেখে মোমবাতি জ্বালাতে মাঠে নেমে এলেন বারাসতের একটি পাড়ার বাসিন্দারা। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ, স্বাতী চক্রবর্তী, সুদীপ ঘোষ
কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে, কিছু ক্ষণের জন্য নয়। আলো ঘিরেই তাঁদের জীবন। কেউ সিনেমা হলে টর্চ জ্বেলে দর্শকদের পথ দেখিয়ে বসানোর ব্যবস্থা করেন। কেউ আবার নানা অনুষ্ঠানস্থলে
আলোর বরাত নেন। কারও আবার গোটা জীবন কেটেছে শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাগানো বাতিস্তম্ভে সময় মতো আলো জ্বালিয়ে বা ভোরে তা নেভাতে গিয়ে।
রবিবার করোনা-যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াই মেনে ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে মোমবাতি, প্রদীপ বা মোবাইল জ্বেলে ‘মহাশক্তিকে জাগ্রত’ করার দেশজোড়া চেষ্টা শুরু হওয়ার আগে তাঁরা বলছিলেন, ‘‘সবটাই চমক। এ ভাবে আলো জ্বেলে তো গরিবের পেট ভরে না। এর চেয়ে দেশের রোগ সারবে কীসে, তা ভাবলে ভাল হয়।’’
বিরাটির বাসিন্দা, বছর একষট্টির রামকৃষ্ণ কুণ্ডু কলকাতা পুরসভার আলো বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন ১৯৮৫ সালে। যে ওয়ার্ডে যখন কর্মরত থেকেছেন, সেখানকার রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলি সন্ধ্যা নামলেই
জ্বালিয়ে দেওয়া এবং ভোরে নিভিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর দায়িত্ব। অক্টোবরে মুখের ক্যানসার ধরা পড়ে রামকৃষ্ণবাবুর। তখনই অবসর নেন। তত দিনে অবশ্য পুরসভার সব বাতিস্তম্ভই স্বয়ংক্রিয় হয়ে গিয়েছে। তবু এলাকায় ঘুরে কোন বাতিস্তম্ভ জ্বলছে আর কোনটিতে সমস্যা রয়েছে, তা দেখে রিপোর্ট দেওয়াই তাঁর কাজ ছিল।
প্রৌঢ় রামকৃষ্ণবাবু এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের মতো মানুষদের কাছে আলো জ্বালানো আর পাঁচটা কাজের মতো স্রেফ একটা কাজ নয়। অনেক আবেগ জড়িয়ে। নরেন্দ্র মোদী এই ধরনের আবেগ নিয়ে নানা সময়ে খেলেন। কখনওই কিছুর সমাধান দেন না। উল্টে এমন কিছু বলেন, যাতে মানুষের দৃষ্টি ঘুরে যায়।’’ খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘সারা বছর রাস্তার আলো জ্বালিয়েও আমাদের জীবনের আঁধার কাটেনি। মেয়ের এমএ পড়া সবে শেষ হয়েছে। চাকরি পায়নি। কী করে ক্যানসারের চিকিৎসা চালাব, জানি না।’’
জীবন-যন্ত্রণার একই গল্প বাগুইআটির আরতি সিনেমা হলের বাবলু দাসের। অবস্থা এতই সঙ্গীন যে, দর্শকদের আসন দেখানোর পাশাপাশি হলের মূল যন্ত্রও তাঁকেই চালাতে হয়। মাস গেলে হাতে পান সাড়ে তিন হাজার টাকা। বাবলু বলেন, ‘‘১৯৮৩ সাল থেকে কাজ করছি। যখন শুরু করেছিলাম, সিনেমা হলের ব্যবসা তখন রমরমা। কোনও দিন এই হাল হবে ভাবিনি।’’ জানালেন, এখন বছর তিরিশের ছেলের আয়ই ভরসা তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর সংসারে। লকডাউন চললেও এক দিন অন্তর কাজে বেরোতে হচ্ছে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সেই ছেলেকে।
প্রায় একই রকম গল্প প্রাচী সিনেমা হলের কর্মী গণেশরাম বারির। গত ৩৫ বছর তিনি ওই হলের সঙ্গে যুক্ত। টিকিট পরীক্ষা করে দর্শকদের আসন দেখিয়েই তাঁর সংসার চলে। মোদীর কথা মতো আলো জ্বালিয়েছিলেন? প্রথমে চুপ করে থাকলেন প্রৌঢ়। পরে বললেন, ‘‘ভাবতে আর ভাল লাগে না। ছেলেখেলার সময় নয় এটা। কবে হল খুলবে, সব স্বাভাবিক হবে— সেটাই জানতে চাই।’’ চন্দননগরের বাসিন্দা শ্যামল কর্মকার কলকাতার বেশ কিছু পাড়ার পুজোয় আলোর বরাত নিয়ে রেখেছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব বাতিল। শ্যামল বলেন, ‘‘কোনও আলো জ্বেলেই এই অন্ধকার কাটানো যাবে না। এটা সকলে যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।’’
জয়া সিনেমা হলের কর্মী রাজু মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘আমাদের মতো হলের টিকিট পরীক্ষকদের আসার (usher) বলে। অর্থাৎ, যাঁরা দর্শকদের পথ দেখান। চমক ছেড়ে আমাদের পথ দেখান প্রধানমন্ত্রী।’’