রোগী মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে দু’দিন ধরে তাণ্ডব চলছে গোটা রাজ্যে। সোমবার রাতে এন আর এস হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের উপরে রোগীর পরিবারের চড়াও হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে উত্তাল হয়েছে পরিস্থিতি। অথচ দেখা যাচ্ছে, অগ্নিগর্ভ এই ছবি বদলের চেষ্টার পরিবর্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নেমে পড়েছেন আস্তিন গুটিয়ে। কেউ ঘটনার কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তুলছেন। কেউ আবার তাঁদের মতো করেই রাজনৈতিক রং ঢালতে বদ্ধপরিকর।
অথচ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতে আবদ্ধ নন। যদি আমি আজ একটি সম্প্রদায়ের লোকের হাতে লাঞ্ছিত হই, সেই অপমান কি অন্য সম্প্রদায়ের লোকের থেকে পেলে কম হত? সুতরাং ওই ভাবনা অযৌক্তিক। চিকিৎসা পরিষেবা দিতে গিয়ে অন্যায় ভাবে লাঞ্ছিত হওয়াই মূল সমস্যা। সমস্ত ডাক্তারের কাছে আমার আবেদন, এই আন্দোলনের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকতে দেবেন না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পরে সামগ্রিক ভাবে যে আন্দোলন দানা বেঁধেছে, দোহাই, সেই আন্দোলনে ধর্মের রং লাগাবেন না।
এই আন্দোলন কেন? — তা থেকেই সরে যাচ্ছে সমাজ। অনুরোধ, এমন অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকুন নেতারা। এই সব সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বার্তা চিকিৎসকদের আন্দোলনের ঐক্য নষ্ট করবে। সামাজিক বিপর্যয় বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি করবে।
রুদ্ধ: এসএসকেএমের ইমার্জেন্সির সামনে ব্যারিকেড। বুধবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
আন্দোলনের বিষয় কী? সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে পরিষেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের এই আন্দোলন। সরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরিকাঠামো উন্নত করার আন্দোলন। এই আন্দোলন আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে। অথচ প্রশাসনিক স্তরে কোনও পদক্ষেপ করা হয় না! পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে যায়, তখন কিছু আশ্বাস দেওয়া হয়। পরে সেই আশ্বাস ঢুকে যায় হিমঘরে।
গত কয়েক বছরে বারবার চিকিৎসা পরিষেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হতে হয়েছে সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকদের। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা আইন অনুযায়ী ধরা পড়লেও শাস্তি কি কিছু হয়েছে? আমাদের তো অন্তত জানা নেই। অথচ ২০০৮ সালে মেট্রো চ্যানেলের সামনে দিনরাত অবস্থান করে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য শাখার তরফে চিকিৎসকদের সুরক্ষার আইন, ‘মেডিকেয়ার অ্যাক্ট-২০০৯’ তৈরি করিয়েছিলাম আমরা। তখন রাজ্যের শাসকদল বামফ্রন্ট। সেই আইনে বলা আছে, হাসপাতালের মধ্যে কোনও নিগ্রহের ঘটনা ঘটলে বা সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর হলে অভিযুক্তের পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে জেল হবে। ওই আইন তৈরির পরে পরিবর্তন একটাই নজরে এসেছে। তা হল, হাসপাতালের সাইন বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে সেই আইনের কথা। অথচ প্রশাসন এ বিষয়ে আদৌ গুরুত্বই দেয়নি।
চিকিৎসক নিগ্রহের কিছু ঘটনা ঘটলেই দ্রুত মিছিল, আন্দোলন, ফেসবুক পোস্ট আর সেই পোস্টে দু’তরফের তর্কেই আটকে থাকে গোটা বিষয়। পুরোটাই স্বাস্থ্য-প্রশাসন এবং রাজ্য-প্রশাসনের ব্যর্থতা। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় যে ভাবে আমরা পরিস্থিতি বিচার করছি, জুনিয়র ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা তত সহজ হবে না। কারণ, প্রথমত নিগ্রহের পরিস্থিতিতে ওঁদেরই সরাসরি বিক্ষুব্ধ জনতার মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের নয়। দ্বিতীয়ত, বয়স কম হওয়ায় দ্রুত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন ওঁরা। পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যর্থতা জুনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যে হতাশার বাতাবরণ তৈরি করছে। যা থেকে জন্ম নিচ্ছে সরকারি প্রতিশ্রুতির প্রতি ওঁদের সন্দেহ এবং অসহিষ্ণুতা। এর জেরে সরকারের নীতি সম্পর্কে নমনীয় মনোভাব এখন ওঁদের মধ্যে প্রায় নেই। এ সবের জন্য দায়ী কিন্তু রাজ্য সরকার।
ইতিমধ্যেই আন্দোলনের দু’দিন অতিক্রান্ত। চিকিৎসার এই অচলাবস্থা কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্তারা আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে এখনই কথা বলুন। তা না হলে সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। কারণ, দিনের পর দিন চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে যাওয়া রোগীর পরিজনেদের মধ্যেও ক্ষোভ জমছে। তা যেন বড় আকার না নেয়। এই পরিস্থিতিতে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিশিষ্টজনেদেরও এগিয়ে আসা জরুরি।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।