আতঙ্ক: পুরকর্মীদের অপেক্ষায় না থেকে ব্লিচিং ছড়াচ্ছেন এক বাসিন্দা।
তিন দিনের টানা জ্বরে সদ্য পাড়ায় মৃত্যু হয়েছে মাধুরী বৈদ্য নামে এক গৃহবধূর। বাড়িটার সামনে দাঁড়ালেই ভেসে আসছিল আত্মীয়দের কান্নার আওয়াজ। একটু দূরে পাড়ার কয়েক জন যুবকের জটলা। চোয়াল শক্ত করে তাঁরা বলছেন, ‘‘এক বার আসুন না ভোট চাইতে। তখন দেখে নেব।’’ পাশে থাকা অন্য জনের মন্তব্য, ‘‘কোন মুখে ভোট চাইতে আসবেন কাউন্সিলর?’’
নিউ টাউনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রমোদগড় ১ থেকে ১২ নম্বর গলির অনেক বাসিন্দাই সন্ধ্যা নামলে ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় বসেন। অপেক্ষা করেন মশা মারার কামানের। কিন্তু কোথায় কী? সন্ধ্যায় মশার উৎপাত যখন সব থেকে বেশি, তখন কোথাও দেখা মেলে না মশা মারার কামানের। স্থানীয় বাসিন্দা কার্তিক মিস্ত্রি বলেন, ‘‘ওঁরা আসেন দুপুরে। তখন কামান দাগায় বরং বেশি মশা ঘরে ঢুকে যায়। যখন দরকার, তখন ওঁদের পাওয়া যায় না।’’
পরপর এতগুলো মৃত্যুর পরেও প্রমোদগড়ে পুরসভা ব্লিচিং ছড়িয়েই দায় সেরেছে বলে ক্ষোভ এলাকাবাসীর। প্রমোদগড়ের পাঁচ নম্বরই হোক বা আট নম্বর গলি, দেখা গেল ড্রেনের উপরে আলপনার মতো সাদা ব্লিচিং। স্থানীয়দের প্রশ্ন, ওই ব্লিচিং কি আদৌ কার্যকর? এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় বিশ্বাস বললেন, ‘‘পুরসভা থেকে যে ব্লিচিং দেয়, তাতে কোনও গন্ধ নেই। মশার তেলে স্প্রে করে গেলে তার গন্ধও কয়েক মিনিটে গায়েব হয়ে যায়। পুরসভা ব্লিচিং ও মশার তেলের নামে কতটা খাঁটি জিনিস ছড়াচ্ছে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। না হলে মশার দাপট কমছে না কেন? এখনও পাড়ার অধিকাংশ বাড়িতেই কেউ না কেউ জ্বরে ভুগছেন। আতঙ্কে রয়েছি।’’
প্রমোদগড়ের ৮ নম্বর গলির এমনই একটি ঘরে গিয়ে দেখা গেল, পরিবারের পাঁচ জনেরই জ্বর। দুলাল মিস্ত্রি নামে ওই বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘জ্বরের সঙ্গে গা-হাত-পায়ে ব্যথা। রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছি। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আতঙ্কে রয়েছি।’’ সদ্য ডেঙ্গি থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ঝুমা অধিকারী বললেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছি কয়েক দিন আগে। ফের মশা কামড়াতে শুরু করেছে।’’ যদিও এলাকার কাউন্সিলর চামেলি নস্করের দাবি, ‘‘মশার দাপট অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এ বার এলাকার বাসিন্দারা একটু সচেতন হলেই ডেঙ্গি পুরোটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’’
স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে মশার দাপটের মধ্যেই সন্তানকে খাওয়াচ্ছেন লক্ষ্মণ সরকার। প্রমোদগড়ে।
কিন্তু মশা কমেনি বলেই দাবি কেষ্টপুরের সিদ্ধার্থনগর বা মিশন বাজারের বাসিন্দাদের। অলিগলিতে ঘুরলেই টের পাওয়া যায় সেই দাবির সত্যতা। সদ্য ডেঙ্গিতে স্ত্রী ঋতু সরকারকে হারিয়েছেন সিদ্ধার্থনগরের লক্ষ্মণ সরকার। দু’বছরের ছেলে অয়নকে কোলে নিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। অয়নের পায়ের সামনে মশা ঘুরছে দেখিয়ে লক্ষ্মণ বললেন, ‘‘কোনও ভাবেই মশার দাপট কমছে না। ছেলেটাকে কী করে বাঁচাব বলুন তো? জেগে থাকলে এইটুকু শিশু কিছুতেই মশারির ভিতরে থাকতে চায় না। আর বাইরে বেরোলেই মশা ছেঁকে ধরছে।’’ সিদ্ধার্থনগর এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এলাকায় মৃত্যুর ঘটনার পরে পুরসভার টনক নড়েছে। ব্লিচিং ও মশার তেল ছড়ানো হচ্ছে। মশা মারার কামানও আসছে নিয়মিত। কিন্তু খোলা ড্রেনের ময়লা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘খোলা ড্রেনে জমে থাকা জঞ্জালে মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে। পুরকর্মীদের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও ওঁরা নর্দমা পরিষ্কার করছেন না। আমরা নিজেরাই তাই ড্রেন পরিষ্কারে নেমেছি।’’
মিশন বাজারের বাসিন্দারা যেমন শুধু পুরসভার উপরে নির্ভর করে নেই। ঘরে ঘরে অনেকেই কিনে রেখেছেন মশারোধক মলম। মিশন বাজারের সুবীর পাল ও মালতি পাল দিন কয়েক আগে হারিয়েছেন দশ বছরের ছেলে সৌম্যজিৎকে। সুবীরবাবু বললেন, ‘‘মশার হাত থেকে বাঁচাতে ছেলেকে বলতাম মশারির ভিতরে থাকতে। তবু বাঁচাতে পারলাম না। তিন দিনের জ্বরে মারা গেল।’’ টেবিলে রাখা মশারোধক মলম দেখিয়ে বলেন, ‘‘এখন এগুলো বড় ছেলেকে মাখিয়ে রাখি। ওকে যেন মশা না কামড়ায়।’’
সুবীরবাবুর মুখ-চোখে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ফুটে ওঠে।
নিজস্ব চিত্র