উৎসব: কালীপ্রতিমা বিসর্জনের মিছিল। শুক্রবার, বাজেকদমতলা ঘাটে। ছবি: সুদীপ ঘোষ
দীপাবলির উদ্যাপনে শুধু দূষণই বাড়ে না, সঙ্গে বাড়তে পারে ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী এডিস ইজিপ্টাই মশার দাপটও। এমনই আশঙ্কা করছেন গবেষকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, রাতে যদি প্রচুর আলো জ্বেলে দিনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা যায়, তা হলে সেই আলোয় সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গির মশা।
বুধবারই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে যাদবপুর থানা এলাকার প্রিন্স গোলাম হুসেন শাহ রোডের বাসিন্দা এক তরুণীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। যা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে ডেঙ্গি মোকাবিলায় কলকাতা পুরসভার ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু তারই মধ্যে আরও একটি বিষয় ভাবাচ্ছে মশা গবেষকদের একাংশকে। শহর জুড়ে আলোর উৎসব ডেঙ্গির মশা এডিস ইজিপ্টাইদের দাপাদাপি কি বাড়িয়ে দিয়েছে?
কারণ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মশা নিয়ে করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণা এমনই প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে। ওই গবেষণার মূল বিষয় ছিল, রাতে আলো জ্বেলে যদি দিনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, তা হলে সেখানে এডিস ইজিপ্টাই বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে কি না, তা দেখা। এমনিতে আলোয় যে এডিস কামড়ায়, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।
কিন্তু রাতের কৃত্রিম আলোয় এডিস বেশি কামড়ায় কি না বা তাদের চরিত্রে কোনও পরিবর্তন আসে কি না, সেটাই দেখতে চেয়েছিলেন গবেষকেরা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মশা গবেষণাগারে আলো জ্বেলে কৃত্রিম ভাবে দিনের মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে একটি পায়রার উপরে পরীক্ষা করে দেখা হয়, এডিস কখন কখন তাকে কামড়াচ্ছে। গবেষকেরা লক্ষ করেন, অন্ধকারে পায়রার গায়ে এডিস কামড় বসাচ্ছিল খুবই কম। কিন্তু আলো জ্বালতেই সেই কামড়ানোর হার বহু গুণ বেড়ে যায়।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক ও মশা গবেষণাগারের বিজ্ঞানী গৌতম চন্দ্র বলেন, ‘‘কালীপুজো-দীপাবলিতে যে ভাবে শহরে আলো জ্বলে, তাতে এডিসের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, আমরা পরীক্ষায় দেখতে পেয়েছি, কী ভাবে রাতে আলো জ্বলার সময়ে মশার কামড়ানোর ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসে।’’ প্রসঙ্গত, গৌতমবাবু মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচির ক্ষেত্রে কলকাতা-নিউ টাউন উন্নয়ন পর্ষদের মুখ্য পরামর্শদাতাও। ওই গবেষণার সঙ্গেই যুক্ত সিনিয়র রিসার্চ স্কলার অনিকেত সিংহ বলেন, ‘‘কৃত্রিম আলোতেও ওদের কামড়ানোর হার বেড়ে যায়। ফলে আলো বেশি থাকলে ওরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।’’
এর আগে এডিসের কামড়ানোর সময় নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেই গবেষণা ছিল শুধুমাত্র কলকাতা-কেন্দ্রিক। তাতে দেখা গিয়েছিল, সারা দিনে সক্রিয় থাকলেও শহরে এডিস ইজিপ্টাইয়ের কামড়ানোর মূল সময় হল, সকাল আটটা থেকে ন’টা এবং বিকেল পাঁচটা থেকে ছ’টা। ৮৪ শতাংশ এডিস ইজিপ্টাই দিনের ওই সময়েই বেশি কামড়ায়। বাকি ১৬ শতাংশ এডিস মশা কামড়ায় রাতে। তার মধ্যে সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত দশটা এবং ভোর চারটে থেকে সকাল ছ’টা হল ওই এডিসের কামড়ানোর তুঙ্গ সময়। সেই গবেষণা সম্পর্কে স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয়কুমার হাটি বলেন, ‘‘দিনে যখন বেশি কামড়ায়, তখন রাতে সেই একই পরিবেশ তৈরি হলে কামড়ানোর হার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’ এ বিষয়ে গৌতমবাবু বলেন, ‘‘গবেষণাগারের বদ্ধ জায়গায় পরীক্ষা করে যে ফলাফল আমাদের নজরে এসেছে, মুক্ত আলোয় পরীক্ষা করে সেই ফলাফল একই থাকে কি না, তা দেখা দরকার। দীপাবলি বা ওই রকম কোনও উৎসবের সময়েই তা দেখা সম্ভব। আগামী দীপাবলিতে মুক্ত জায়গায় এই পরীক্ষা করার কথা ভাবছি আমরা।’’
তবে রাতে আলোর ব্যবস্থা হলে তা রাতারাতি এডিসের চরিত্রে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত নন গবেষকদের আর একটি অংশ। ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এর অধীনস্থ স্বশাসিত সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যালেরিয়া রিসার্চ’ (এনআইএমআর)-এর বেঙ্গালুরু ইউনিটের প্রধান বিজ্ঞানী সুশান্তকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘এত তাড়াতাড়ি চরিত্রে বদল আসে বলে মনে হয় না। কারণ, কালীপুজো-দীপাবলি তো ক্ষণিকের আলো। চরিত্রে বদল আসার জন্য রাতে দীর্ঘস্থায়ী আলোর ব্যবস্থা দরকার। কারণ, ফটো পিরিয়ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ হতে সময় লাগে।’’
তবে সক্রিয় হলেও তাতে মশককুলের বিপদ রয়েছে বলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন গবেষকেরা। কারণ, শব্দবাজি-আতসবাজির দূষণ। এমনিতে চলতি বছরের দীপাবলি হল সাম্প্রতিক সময়ের সব থেকে ‘দূষিত’ দীপাবলি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্যই দেখাচ্ছে, শহরের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ১০) ও অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার লেখচিত্র কী ভাবে (পিএম ২.৫) ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী! বৃহস্পতিবারও রাত ১২টায় বি টি রোডের রবীন্দ্রভারতী এলাকায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫৮০.২৩ মাইক্রোগ্রাম, রাত ১টায় যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯৩.১ মাইক্রোগ্রাম। রাত ২টোয় আরও বেড়ে তা হয় ৬১২.৮ মাইক্রোগ্রাম। একই ভাবে ওই এলাকায় রাত ১২টায় পিএম ২.৫-এর হার ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৪৪.৩ মাইক্রোগ্রাম। রাত ১টা ও রাত ২টোয় ওই হার বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৫৪.৫৭ ও ৩৮৫.৪ মাইক্রোগ্রাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এলাকায় রাত ১২টায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬০.০৫ এবং পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ছিল ১৮৬.৭৩ মাইক্রোগ্রাম। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘এটা শাপে বর বলতে পারেন। দূষণের এই ধোঁয়া এডিসের শ্বাসছিদ্রের ভিতরে ঢুকে শ্বাসকষ্টজনিত নানা সমস্যা তৈরি করে। তাতে কিছুটা হলেও মশককুল ধ্বংস হয়।’’