গতি: চটজলদি খাবার পৌঁছে দিতে মোটরবাইকে গন্তব্যের পথে অনলাইন খাবার সরবরাহকারী সংস্থার কর্মী। রবিবার, এস এন ব্যানার্জি রোডে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
বর্ষবরণের রাত তখন সবে ১২টা। উট্রাম রোড দিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকতে গাড়ির লম্বা লাইন চোখে পড়ছিল। সেখানেই যানজটে আটকে থাকা এক ব্যক্তি গাড়ির দরজা খুলে নামতে যেতেই বিপত্তি। দরজায় এসে ধাক্কা মারে একটি মোটরবাইক। যার চালক, একটি অনলাইন খাবার সরবরাহকারী সংস্থার কর্মী! যানজটের মধ্যে দিয়ে কোনও মতে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লেও হেলমেট থাকায় কোনও মতে রক্ষা পায় তাঁর মাথা। সকলে মিলে ধরাধরি করে তুলতেই সেই বাইকচালক বললেন, ‘‘আজ প্রচুর অর্ডার। ১২টার মধ্যে শেষ করতে পারলে ভাল ইনসেন্টিভ পাওয়া যাবে। তাই একটু হুড়োহুড়ি করে ফেলেছি।’’
বর্ষবরণের রাত এবং বছরের প্রথম দিনে এমনই উপরি আয়ের মোহে একাধিক অ্যাপ-নির্ভর সংস্থার কর্মী দুর্ঘটনায় পড়েছেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। কোনও ঘটনায় মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চলা অ্যাপবাইক ধাক্কা মেরেছে পথচারীকে। কোথাও দিনভর কাজ করে ক্লান্ত শরীরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার পথে মোটরবাইক নিয়ে সরাসরি ধাক্কা মেরেছেন বাতিস্তম্ভে। লালবাজার সূত্রের খবর, ট্র্যাফিক পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ জানুয়ারি মিলিয়ে নথিভুক্ত হওয়া এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪৩টি। আর এমন বিধিভঙ্গকারী বাইক বা সাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে ৭৩টি।
অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী সংস্থার এক কর্মীর দাবি, লকডাউন এবং গত প্রায় দু’বছরে করোনা পরিস্থিতির জেরে অনেকেই কর্মহীন হয়ে এই পেশায় এসেছেন। তাই পরিস্থিতি বুঝে পারিশ্রমিকও কমিয়ে দিয়েছে অ্যাপ-নির্ভর সংস্থাগুলি। আগে যে দূরত্বে খাবার পৌঁছে দিলে ৪৫ টাকা মিলত, এখন সেটায় দেওয়া হয় ২০-২৫ টাকা। রেস্তরাঁয় অপেক্ষা করতে হলে তিন মিনিটের পর থেকে প্রতি মিনিটে দেওয়া হয় ১ টাকা করে। কিন্তু তাতেও অর্ডার পিছু খুব বেশি হলে ৩০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এর পরেও কিছু উপরি থাকে ঠিকই, কিন্তু ন্যূনতম ১২০ টাকা উপরি পেতে হলেও ৩৩০ টাকার কাজ করতে হয়। অর্থাৎ অন্তত ১১টা অর্ডার পৌঁছে দিতেই হয়। কিন্তু বর্তমানে কর্মীর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছে যে, দিনে ১১-১২ ঘণ্টা কাজ করেও অনেক দিনই পর্যাপ্ত অর্ডার পাওয়া যায় না।
এর মধ্যেই বড়দিন, ৩১ ডিসেম্বর, ১ জানুয়ারির মতো দিনগুলিতে অর্ডার পিছু অনেক বেশি উপরি দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী একটি সংস্থার কর্মী বলেন, ‘‘৩১ ডিসেম্বরের থেকেও বেশি ভাল ইনসেন্টিভ দেওয়া হয়েছে ১ জানুয়ারি। ১০ ঘণ্টা কাজ
করতে পারলে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত আয়ের সুযোগ ছিল। সাধারণ সময়ে যে অর্ডার পৌঁছে দিলে ৩০ টাকা মেলে, ৩১ ডিসেম্বর সেই দূরত্বের জন্য মিলেছে গড়ে প্রায় ৬৭ টাকা। আর একটু বেশি সময় কাজ করলেই অর্ডার পিছু দিয়েছে ৭০ টাকারও বেশি। অর্থা,ৎ অন্য দিনের থেকে প্রতি অর্ডারের জন্য ৪০ টাকা বেশি আয় হয়েছে।’’
আর এক সংস্থার কর্মী জানালেন, ‘‘১ জানুয়ারি আমাদের সংস্থা থেকে প্রত্যেক অর্ডারের জন্য ৭৫-৮০ টাকা রোজগারের সুযোগ ছিল। অন্য সময়ের থেকে যা ৫০ টাকা বেশি। হিসাবটা শুধু মাথায় রাখতে হয়। যত কম সময়ে যত বেশি অর্ডার পৌঁছে দেওয়া যাবে, ইনসেন্টিভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে তত দ্রুত!’’
আর তাই কম সময়ে বেশি অর্ডার পৌঁছনোর ঝুঁকি নেওয়ার কারণেই কি ঘটেছে পর পর দুর্ঘটনা? অতীতে এমন ঘটনা বার বার ঘটলেও উৎসবে উপরি আয়ের ঘোষণা বন্ধ হয় না কেন? অ্যাপ-নির্ভর সংস্থাগুলির দাবি, তারা কখনও ট্র্যাফিক বিধিভঙ্গ করতে উৎসাহ দেয় না। উল্টে চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে বিশেষ ক্লাস করানো হয়। অনলাইন খাবার সরবরাহের এক সংস্থার কলকাতা জ়োনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক দিবাকর বর্মা বললেন, “তাড়াহুড়ো যাতে করতে না হয়, তা-ই সর্বক্ষণ ও আংশিক সময়ের কাজের ভাগাভাগি রয়েছে। উপরি আয়ের জন্য তো বটেইে, কোনও কারণেই বিধি ভেঙে মোটরবাইক চালানো উচিত নয়।”