ধ্বংস-ক্ষত: কবরস্থানের শুশ্রূষায় শাহিদ। (ডান দিকে) মাজারের সামনে ভেঙে পড়া গাছের গুঁড়ি। নিজস্ব চিত্র
যেন আকাশ থেকে পড়ে চার দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মৃত নক্ষত্রেরা। কয়েক দিন আগের ধ্বংসচিহ্ন জড়াজড়ি করে রয়েছে পড়ে থাকা সেই গাছেদের গায়ে। আর সমস্ত কবরস্থান যেন এ ভাবেই ঢাকা পড়েছে ‘পাতার পোশাকে’। ডাল সমেত পাতা এমন ভাবে উপড়ে পড়েছে মাটির উপরে, যার নীচে মিশে রয়েছেন অনেকের আত্মজন। মাটির মধ্যে মাটি হয়ে, আবহমানের স্মৃতি হয়ে। এর আগেও একাধিক বার কথা হয়েছে আব্দুল মজিদের সঙ্গে। কখনও এত বিষণ্ণ দেখায়নি তাঁকে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে। তাই ঘরের বিছানায় শুয়েই দূরের হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা গাছটি দেখিয়ে আব্দুল বলতে থাকেন, ছোট্টবেলায় কত খেলেছেন গাছটির ডাল ধরে। কথাগুলি বলার সময়ে বছর পঁয়ষট্টির আব্দুলের চোখে-মুখে যেন কৈশোরের হাওয়ার ঝাপটা।
হাওয়ার ঝাপটা? নাহ্!
কয়েক দিন আগের হাওয়ার সেই ঝাপটার কথা আর মনে করতে চান না আব্দুল। যে ঝাপটায় লন্ডভন্ড হয়েছে শহর, সঙ্গে এপিসি রোড লাগোয়া নাখোদা মসজিদের এই কবরস্থানও। আব্দুলরা চার প্রজন্ম ধরে এই কবরস্থানের দেখভাল করছেন। নাখোদা মসজিদের ট্রাস্টি বোর্ডের পরিবারের সদস্যদের জন্যই শুধু এই শীতলপাটি-মাটি। শুধুমাত্র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের পরিবারের কারও মৃত্যু হলেই তাঁকে এখানে কবর দেওয়া হয়। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর একা কবর দিতে পেরে ওঠেন না আব্দুল। বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে মহম্মদ শাহিদ তাঁকে সঙ্গ দেন। শাহিদ বলছিলেন, ‘‘বাবা বলেছিল ঝড়ের সময়ে সবাই যেন একসঙ্গে থাকি। মরার হলে সবাই একসঙ্গে মরব!’’ বাবা, মা, ভাই, স্ত্রী, দুই সন্তান মিলিয়ে শাহিদের মোট সাত জনের পরিবার। আব্দুলের কথা মতোই আমপানের ধ্বংসলীলার সময়ে সকলে একটি ঘরে গুটিসুটি মেরে বসেছিলেন। সাত ও তিন বছরের দুই সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন শাহিদের স্ত্রী। খুপরি ঘরের জানলা খুলে যা দেখেছিলেন শাহিদেরা, প্রথমে তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একশো বছরেরও বেশি পুরনো গাছ, ডালপালা একের পর এক উপড়ে পড়েছে মাটিতে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। যখন গাছগুলি পড়ছিল, তখন ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠছিলেন শাহিদেরা। কী প্রবল অসহায় লাগছিল নিজেদের, বলছিলেন শাহিদ।
আরও পড়ুন: আমপানের রোষ থেকে মুক্তি পেল না বটানিক্যাল গার্ডেনও
যেমন ভাবে আমপানের ধ্বংসলীলার সামনে অসহায় দেখাচ্ছে গোটা শহরকে। বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ, বিক্ষোভ। গাছ কাটতে যখন নেমে পড়েছে সেনা, তখনও কবরস্থানে শায়িত মৃতদেহের উপরেই শুয়ে রয়েছে গাছেদের দেহ। যেমন ভাবে মানুষ আর প্রকৃতি আবহমানকাল ধরে থেকে গিয়েছে পাশাপাশি, কাছাকাছি। আব্দুল-শাহিদেরা আমপানের উৎসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, তার নামকরণ, তার গতিপথ সংক্রান্ত কোনও তথ্যই জানেন না। তবু বিজ্ঞানী-গবেষকেরা অনেক তত্ত্বের মাধ্যমে যা বলছেন, সেটাই সহজ কথায় বলছিলেন শাহিদ,— ‘‘প্রকৃতির সঙ্গে আমরা যা যা করেছি এত দিন ধরে, তার ফল এ সব। প্রকৃতি সমস্ত হিসেব রাখে।’’
আরও পড়ুন: ঝড়ে উপড়ানো গাছ ফের রোপণের সিদ্ধান্ত
যেমন হিসেব রাখেন আব্দুল-শাহিদও। কত জনের নশ্বর দেহ শুয়ে রয়েছে এই মাটির নীচে। আরও কত জন সারা জীবনের সংগ্রামের পরে এখানে এসে চির শান্তিতে শোবেন। শুধু সেই শান্তিটুকু ফিরিয়ে আনার জন্য নিষ্প্রাণ গাছের ডালগুলিকে সরাতে চাইছেন শাহিদ। বিড়বিড় করে তিনি বলছিলেন, ‘‘আমরা যদি এখনও না বুঝি, তা হলে আরও কত গাছ এ ভাবে মরে যাবে!’’ আসলে মাটির কাছাকাছি থাকা শাহিদেরাই একমাত্র জানেন, এই মাটি, এই গাছ, মাটিতে শোয়ানো নশ্বর দেহ,— সকলে এক সূত্রে বাঁধা। কোনও একটির সঙ্গে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হলে পুরো ব্যবস্থাই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। তখন অনাহূত অতিথির মতো চলে আসে আমপান, আর তার চলে যাওয়ার পরে পড়ে থাকে শুধু গাছেদের নিষ্প্রাণ দেহ— মৃত নক্ষত্রের মতো, পাখির ভাঙা ডানার মতো!