ছাউনি দেওয়া হয়নি। ভরসা তাই প্লাস্টিক। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবে কোনও ঘরের উপরে ভেঙে পড়েছিল গাছ। কোথাও ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঝড়। তাণ্ডবের সাত দিন পরেও সেই সব ঘর রয়ে গিয়েছে ছাউনিহীন অবস্থাতেই।
কারণ, লকডাউনের শহরে আকাল চলছে মিস্ত্রিদের। লকডাউনের আগে গ্রামে ফিরে যাওয়া মিস্ত্রিদের অনেকেই এখন চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শহরে ফিরতে পারছেন না। ফলে ছাউনিহীন ঘর মেরামত করাতে মিস্ত্রির খোঁজে নাকাল হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। যে ক’জন মিস্ত্রি লকডাউনের মধ্যেও শহরে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়েই টানাটানি চলছে সর্বত্র। অভিযোগ, পুর কোঅর্ডিনেটরের কাছে সাহায্য চাইতে গেলেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
সাঁপুইপাড়ার সুবিমল বর্মণ যেমন জানালেন, ঝড়ের রাতে বাড়ির চাল উড়ে যায়। ঘরে কোমর-জল জমেছিল। স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে ঘরের জল নামাতে পারলেও এখনও মাথার ছাউনি ফেরাতে পারেননি। মঙ্গলবার সুবিমল বলেন, “ঝড়ের পরে গোটা পাড়ায় আলো-জল নেই। যে কারখানায় কাজ করি, সেটি লকডাউনে বন্ধ। জল কেনার টাকাও নেই। ঘরের জমা জল কোনও মতে নামাতে পেরেছি। কিন্তু চাল ঠিক করতে না-পারলে মুশকিল। ফের বৃষ্টি হলে তো আবার আগের অবস্থা হবে!”
একই ভয় গৌরীবাড়ির বাসিন্দা সুব্রত সরকারেরও। তাঁদের অ্যাসবেস্টসের ঘরের উপরে গাছ ফেলেছিল আমপান। গাছ সরিয়ে গত কয়েক দিন প্লাস্টিক দিয়ে ঘর ঢাকতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এ দিকে, ঘরে শয্যাশায়ী বাবা। বহু খুঁজে এক জন মিস্ত্রি পেলেও ১৪ ফুট বাই ৮ ফুটের ঘরের চাল লাগাতে তিনি ৮০ হাজার টাকা চেয়েছেন বলে দাবি সুব্রতের। “সাঁতার শিখিয়ে সংসার চালাই। এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। কী করে মাথার ছাউনি ফেরাব জানি না।”— বলছেন সুব্রত। উপায় না দেখে কলকাতা পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর অমল চক্রবর্তীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। অমলবাবু বলছেন, “গাছ কাটারই লোক পেলাম না, চাল সারানোর মিস্ত্রি দেব কোথা থেকে! গাছ কাটার জন্য আমার এলাকার ঝুপড়িবাসীদের প্রত্যেককে প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে দিয়ে কাজে লাগিয়েছিলাম। না-হলে কাজ উঠত না।”
সুরাহা না পেয়ে প্লাস্টিক দিয়েই ঘরের ছাউনির ব্যবস্থা করেছেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার শাস্ত্রীপল্লির এক বাসিন্দা। বৃষ্টির ভয়ে আবার ছেলেমেয়ের বইপত্র আর জরুরি কাগজ পাড়ার ক্লাবে রেখে এসেছেন বেলেঘাটা চাউলপট্টির বাসিন্দা স্নেহাংশু কর্মকার। তাঁর অভিযোগ, “এখন ঝোপ বুঝে কোপ মারা শুরু হয়েছে। কোথাও ফুট প্রতি অ্যাসবেস্টসের ১০ গুণ বেশি দর চাইছে, কোথাও টিনের দাম দ্বিগুণ হাঁকছে। মিস্ত্রির জন্য বললে শুনতে হচ্ছে, তাঁদের গ্রাম থেকে আনানোর জন্য গাড়িভাড়া দিতে হবে।”
হঠাৎ এমন পরিস্থিতি কেন?
এ দিন জয়নগরের বাড়ি থেকে কোনও মতে কলকাতায় ফিরে পবন হালদার নামে এক মিস্ত্রি বললেন, “ঝড়ের পরেই আমাদের দরকার পড়ে। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি আলাদা। বহু মিস্ত্রি কাজের অভাবে গ্রামে গিয়ে চাষ শুরু করেছিলেন। এখন শহরে কাজ থাকলেও ফিরতে পারছেন না।” পরিস্থিতি এমনই যে, এক বাড়ির কাজ সেরেই অন্য বাড়ি মেরামত করতে ছুটতে হচ্ছে শহরে থেকে যাওয়া মিস্ত্রিদের। তবে দূরত্ব-বিধি বা মাস্কের বালাই না-রেখেই। শ্যামল মরদন নামে এক মিস্ত্রি বললেন, “সারা দিন মাত্র দু’টো কাজ হল। আরও চার জায়গার ফোন এসেছে। এখন মাস্ক দেখলে চলবে! মানুষের মাথা ঢাকতে না পারলে মাস্কে মুখ ঢেকে কী হবে?”