পসরা: ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে বাজারের কাঠামো। তার উপরেই আনাজ নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। বৃহস্পতিবার, তেঘরিয়ায়। নিজস্ব চিত্র
মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে অফিসে জরুরি ইমেল পাঠাতে সকাল থেকে শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। বেসরকারি সংস্থার তরুণ জয়দীপ ধর শেষে উদ্ভ্রান্তের মতো মোটরবাইকে বিমানবন্দরের কাছাকাছি যেতে বাধ্য হলেন। মোবাইলে ‘নেটওয়ার্ক দেবতা’র দেখা মিলল সেখানেই। মহেশতলার আবাসনের পাড়ায় অর্ণব চৌধুরীর দশাও তথৈবচ। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ মাথায় উঠেছিল। মোবাইলে অন্য সংস্থার নতুন সিম ভরে তবে অফিসের কাজ সামলানো সম্ভব হয়েছে।
সামাজিক দূরত্ব-বিধির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে জীবনকে প্রাণপণে গুছিয়ে আনতে চেষ্টা করছিল কলকাতা। বুধবার সন্ধ্যার ঘণ্টা চারেকের ধাক্কায় ফের সব টালমাটাল। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে অন্য যুদ্ধ। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। ফলে পাম্প অকেজো ও পানীয় জলের আকাল। ওয়াইফাই দেবতাও অন্তর্ধান করেছেন। অথচ তিলে তিলে কমে আসছে মোবাইলের প্রাণশক্তি। চার্জ বাঁচিয়ে রাখতে নেট-সংযোগ বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ যেন টাইম মেশিনে অনিবার্য পিছু হাঁটা। মনে হচ্ছে, যোগাযোগের নিরিখে কলকাতাকে রাতারাতি ২১ শতক থেকে ১৯৭০-এর দশকে আছড়ে ফেলেছে আমপান।
কেষ্টপুর থেকে সন্তোষপুরে মায়ের খবর নিতে রীতিমতো হন্যে মেয়ে রেশমি গোস্বামী। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই কাজ করছিল না। দুপুরে ‘আমি ঠিক আছি’ বলে মায়ের মেসেজটা পেয়ে ধড়ে প্রাণ এসেছে। পাইকপাড়ার গলির বাসিন্দা দোলা মিত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই হাঁটুজল ঠেলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। চেনা ওষুধের দোকানে ফোনে চার্জ দিতে পেরে সামান্য স্বস্তি।
গড়িয়াহাটের বাসিন্দা, ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট অয়ন ঘোষের প্রশ্ন, “সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো তা-ও রপ্ত করে নিয়েছিলাম! এখন কত দিন এমন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাঁচতে হবে?” কয়েক দিন হল কোভিড-আতঙ্কের ছায়াতেই সন্তর্পণে নিজের অফিস চালু করেছিলেন অয়ন। এ দিন গাড়িতে বেরিয়েও গাছে অবরুদ্ধ রাস্তায় এগোতে পারেননি। খবর পেয়েছেন, তাঁর কাজের জগতে জড়িত দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা অনেকেরই বাড়ির দফারফা। বাড়িতে অনলাইনে স্কুলের পড়া থেকে ক্যারাটে ক্লাসের নয়া রুটিনও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এখন সে-সবের প্রশ্নই নেই। ফের কবে শুরু হবে, কেউ জানেন না।
শহরের বিভিন্ন রেস্তরাঁ চেনের মালিকেরা অনলাইন খাবার সরবরাহ টিকিয়ে রাখতে নানা পরিকল্পনা করেছিলেন। বেহাল নেট সংযোগে সব ফের থমকে গিয়েছে। বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী, দমদমের অয়ন্তিকা বসুর মুম্বইয়ে জরুরি বৈঠক পরপর বাতিল হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এখন কলকাতার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। ইতিহাসের হাতে নানা ভাবে মার খেয়েছে মন্বন্তর থেকে দেশভাগে ধ্বস্ত এই শহর। অতিমারির ধাক্কায় জবুথবু দিনকালেই আবার ২৫০ বছরের মধ্যে নজিরবিহীন মহাঝড় ঘা মেরে গেল। অসহায় ভঙ্গিতেই এখন এই ‘অবিচার’-এর সঙ্গে লড়াই করছে অপরাজিত কলকাতা।