ভূপতিত: ময়দানে এ ভাবেই উপড়ে পড়েছে বহু গাছ। নিজস্ব চিত্র
গত আড়াই দশকে শহরের সবুজ প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে। এবং তা কমেই চলেছে। ক্রমহ্রাসমান সেই সবুজে এ বার ভাগ বসাল আমপানও! শহরের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গাছ উপড়ে সবুজ হ্রাসের প্রক্রিয়াকেই সে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানী-গবেষকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর প্রভাব পড়তে চলেছে কলকাতার আবহাওয়ার উপরেও।
দেশের একাধিক শহরের সবুজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর (আইআইএসসি) এক সমীক্ষা বলছে, নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় সবুজের পরিমাণ ২৩.৪ শতাংশ ছিল, আড়াই দশক পরে তা হয়েছে ৭.৩ শতাংশ। উল্টো দিকে, কংক্রিটের রাজত্ব বেড়েছে প্রায় ১৯০ শতাংশ! যে হারে সবুজ ধ্বংস হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ২০৩০ সালে শহরে সবুজের সম্ভাব্য পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ৩.৩৭ শতাংশ! এই পরিস্থিতিতে সাড়ে পাঁচ হাজার গাছের ক্ষতি যে অপূরণীয়, মানছেন বিজ্ঞানীরা।
আইআইএসসি-র ‘সেন্টার ফর ইকোলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘এনার্জি অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ডস রিসার্চ গ্রুপ’ কয়েক দশকের উপগ্রহ-চিত্রের তুলনামূলক বিচার করে কলকাতা, আমদাবাদ, ভোপাল ও হায়দরাবাদের সবুজের শতকরা পরিমাণ বার করে। সংস্থার বিজ্ঞানী টি ভি রামচন্দ্র বলছেন, ‘‘দেশে সবুজের গড় ১৮ শতাংশ। সেখানে কলকাতায় সবুজ খুবই কম। তার উপরে ঝড়ের অভিমুখে বাধা সৃষ্টিকারী ম্যানগ্রোভ অরণ্য কেটে ফেলায় সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে পড়ছে। সেখানে আমপানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের সামনে যে এত গাছ ভাঙবে, সেটা প্রত্যাশিত! যে শহরগুলিতে সবুজ ধ্বংস করা হচ্ছে সেখানেই এমন সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।’’
ইউনিসেফের প্রাক্তন পরামর্শদাতা তথা ভূ-বিজ্ঞানী তাপসকুমার ঘটক বলছেন, ‘‘শহরে ন্যাচারাল সয়েল অর্থাৎ সাধারণ মাটি খুবই কম। বাড়ি বা রাস্তায় তা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। পার্কের মাধ্যমে সবুজ সংরক্ষণের চেষ্টাও পর্যাপ্ত নয়।’’ সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে আইআইএসসি-র গবেষণাতেও। সেখানে দেখা গিয়েছে, ১৯৯০ সালে শহরে ‘আর্বান বিল্ট আপ এরিয়া’ অর্থাৎ আবাসিক ও শিল্পক্ষেত্রের শতকরা পরিমাণ ছিল ২.২ শতাংশ। ২০১০ সালে তা হয়েছে ৮.৬ শতাংশ। এই হারে নির্মাণ চললে ২০৩০ সালে কংক্রিটের রাজত্বের সম্ভাব্য হার বৃদ্ধি হবে প্রায় ৫১ শতাংশ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর বিশ্বজিৎ সোম আইআইটি, রুরকির একটি সমীক্ষা উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরে ও আরব সাগরে গড়ে ৫-৬টি ট্রপিক্যাল সাইক্লোন তৈরি হয়, যার কমপক্ষে দু’টি তীব্র (সিভিয়র) আকার ধারণ করে। সেটা তো প্রশাসনের জানার কথা। তার পরেও এই বিপর্যয় কেন? তাঁর কথায়, ‘‘আমপান বোঝাল যে, শুধু স্বল্পকালীন নয়, দীর্ঘকালীন মেয়াদেও কাজ করা প্রয়োজন। যেমন অবৈজ্ঞানিক ভাবে গাছ কাটা, চারা বপন বন্ধ করতে হবে, তেমনই পুরনো ও জীর্ণ বাড়ির সমীক্ষা, ঘূর্ণিঝড়-প্রতিরোধ করতে পারে এমন নির্মাণ, বিদ্যুতের খুঁটি বা কেবলের জট নিয়ে প্রশাসনকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে! না হলে ভোগান্তি চলবেই।’’
গাছ উপড়ানোয় শহরের মাটির চরিত্রে পরিবর্তন হবে কি না, সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে। ‘আইসিএআর-ন্যাশনাল বুরো অব সয়েল সার্ভে অ্যান্ড ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং’-এর বিজ্ঞানীদের একাংশের মত, গাছের শিকড় মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখতে (এগ্রিগেট স্টেবিলিটি) সাহায্য করে। সংস্থার এক সয়েল সায়েন্টিস্টের কথায়, ‘‘এত গাছ পড়ার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মাটির গঠনগত চরিত্র কিছুটা হলেও বদলাবে। কারণ, এখন মাটি-ক্ষয়ের আশঙ্কা রয়েছে।’’ ‘সিএসআইআর-ন্যাশনাল জিয়োফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর ডিরেক্টর বীরেন্দ্র এম তিওয়ারি আবার বলছেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে নোনা জল বৃষ্টির আকারে মাটিতে পড়েছে। ফলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ জলে লবণাক্ত ভাব বাড়তে পারে।’’