প্রতীকী চিত্র
পথ-দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতকে সকাল ১০টায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই শুনতে হয়েছে, “রক্তের ব্যবস্থা করুন, দ্রুত রক্ত লাগবে।’’ ওই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে গেলে রোগীর আত্মীয়দের জানিয়ে দেওয়া হয়, রক্ত নেই। তাঁরা যেন মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে খোঁজ নেন। চড়া রোদে সেই পর্যন্ত ছুটেও শুনতে হয়েছে, “এমনিই তো রক্ত দিয়ে দেওয়া যাবে না। যত ইউনিট রক্ত চান, তত জন রক্তদাতা নিয়ে এলে তবেই পাওয়া যাবে!”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভোজেরহাটের বাসিন্দা ওই রোগীর পরিজনেরা দিনভর ছুটে রক্তদাতা নিয়ে মানিকতলা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে পৌঁছলে বলা হয়, “চারটের পরে কাজ হয় না। কাল সকাল ১০টায় আসুন।” রোগীর পরিবারের আকুতি, “যে দিন সকালে রোগীকে ভর্তি করিয়েছি, তার পরের দিন সকালে রক্ত নিতে হবে? ২৪ ঘণ্টা বিনা রক্তে পড়ে থেকে রোগী তো মারা যাবেন। সেই দায় ওঁরা নেবেন তো?’’
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অভিযোগ, এই মুহূর্তে শহরের সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির এমনই হাল। প্রায় সর্বত্র রক্তশূন্য পরিস্থিতি। তীব্র গরমের সঙ্গে এই অবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে চলতি বিধানসভা নির্বাচন। পাড়ায় পাড়ায় যাঁরা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভোটে ব্যস্ত। ফলে সে ভাবে শিবিরই হচ্ছে না। এর মধ্যে ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে শহরের কোনও সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কই ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, বিকেল চারটে বাজলেই ডাক্তার নেই, টেকনিশিয়ান নেই, লোকবল কম, ক্যাশ কাউন্টার বন্ধ— নানা সাফাই দিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে সঙ্কটজনক রোগীর পরিজনদেরও। ফলে অনেককেই ছুটতে হচ্ছে বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে। রাত তিনটেতেও মিলছে সেখানকার পরিষেবা। যদিও রক্তদাতা নিয়ে গিয়ে রক্ত দেওয়ার বদলে এক ইউনিট রক্ত পেতে তাঁদের ১২০০-১৪০০ টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন যদিও বলছেন, এ জিনিস হওয়ারই কথা নয়। তাঁদের প্রশ্ন, বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে আসা রোগীকে কেন বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে হবে? কলকাতার ছ’টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের পাশাপাশি মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কও ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা। শুধু তা-ই নয়, যে কোনও সময়ে রক্তদাতার রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করার মতো লোকবলও থাকার কথা। কিন্তু অভিযোগ, ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির উপরে নজরদারির অভাবে তা হচ্ছে না। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মীর কথায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, রক্তদাতা আনলে তবেই রক্ত মিলবে, এটা কাউকে বলা যায় না। ব্লাড ব্যাঙ্কে যখন সব গ্রুপের রক্ত কম থাকে, তখন যে কোনও গ্রুপের দাতা আনলে চলে। এক গ্রুপের রক্ত নিয়ে রোগীর গ্রুপের রক্ত দিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে রিপ্লেসমেন্ট ডোনেশন। রোগীর গ্রুপের রক্ত একেবারেই না থাকলে তখনই শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট গ্রুপের দাতাকে আনতে হবে বলা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই দাতার রক্ত নিয়ে, পরীক্ষা করে রোগীর পরিজনেদের দেওয়ার কথা। একে এক্সচেঞ্জ ডোনেশন বলে। কিন্তু এর কোনওটাই না করে, পরে আসুন বলে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।’’ রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী অচিন্ত্য লাহা বলেন, “বার বার প্রতিবাদের পরেও প্রশাসনের হুঁশ ফেরে না।”
রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের যুগ্ম অধিকর্তা (ব্লাড সেফটি) গোপাল বিশ্বাস যদিও বললেন, “ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে রক্তের খুবই সঙ্কট চলছে। বাধ্য হয়ে আমরা
উদ্যোক্তাদের বলেছি, ৫০টি শিবির করতে পারলে এক হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। সেই টাকা তাঁরা প্রচারের কাজে লাগাতে পারবেন।’’ একই সঙ্গে গোপালবাবুর দাবি, “ব্লাড ব্যাঙ্কে ২৪ ঘণ্টা কাজ চালানোর মতো লোকের অভাব চলছে করোনা পরিস্থিতির পর থেকেই। তবে দিন কয়েকের মধ্যেই অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”