আহ্বান: নতুন বছরের সূচনার আগে এক দোকানি। বুধবার, উত্তর কলকাতায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
প্রথম দফার লকডাউন ছিল টানা ২১ দিন। ১৪ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত। গত বছরের মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ঘোষণা করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, বাংলা নববর্ষের উৎসব হচ্ছে না। তবে ব্যবসায়ীদের অনেকে ভেবেছিলেন, অক্ষয় তৃতীয়ায় খাতাপুজো করে সৌভাগ্য কামনা করবেন। কিন্তু বেড়ে যায় লকডাউন। এ বছর লকডাউন না থাকলেও, সংক্রমণ আছে পুরোমাত্রায়। তবে বর্ষবরণের প্রস্তুতি দেখলে মনে হবে যেন গত বছরের খামতি পূরণের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন অনেকে!
হালখাতার খদ্দের টানতে রীতিমতো সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে বৌবাজারের সোনাপট্টি, মধ্য কলকাতার লোহাপট্টি ও বড়বাজারের ব্যবসায়ি মহলে। বাদ নেই কলেজ স্ট্রিট বা শিয়ালদহের কাগজের পাড়াও। সংক্রমণের নিরিখে দেশে ও রাজ্যে যে রোজই রেকর্ড হচ্ছে, আয়োজন দেখে তা মনে হওয়া দুষ্কর। তাই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এই বেপরোয়া মনোভাব বাড়িয়ে দেবে না তো করোনার সংক্রমণ?
বৌবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী তারকেশ্বর সাহা বললেন, “ব্যবসায়ীদের রোগের ভয় করলে চলে না। আমি সে ভাবে মাস্ক পরি না, তা-ও কিছু হয়নি। গত বছর জোর করে লকডাউন করল বলে ধুমধাম করতে পারিনি।’’ বছর তেষট্টির ওই ব্যবসায়ী জানান, অন্তত এক হাজার ক্রেতা আসবেন বলে ধরেছেন। প্রথমেই ঠান্ডা পানীয়, পরে বসে খাওয়া বা প্যাকেট নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। সঙ্গে ‘লাকি ড্র’-এর মাধ্যমে উপহার। সব কি জীবাণুমুক্ত করা থাকছে? বৃদ্ধ বললেন, “বললাম যে! ভয় পেলে চলে না। যাঁরা আসবেন, তাঁরাও ভয় না পেয়েই আসবেন। অতিথিরা কেউ মাস্ক না পরলেও কিছু বলব না।’’ বৌবাজারেই আর একটি দোকান সাজাতে ব্যস্ত কয়েক জনের মুখে মাস্ক না দেখে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আক্রান্তের সংখ্যা কত জানেন? এক জন বললেন, “মাস্ক মাস্ক করেই ব্যবসা লাটে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গত বছর ১০ হাজার ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট নষ্ট হয়েছিল।’’
বড়বাজারের একটি দোকানের মালিক শ্যামাপদ কর্মকার আবার ফাঁপরে পড়েছেন বৃদ্ধ বাবা রমাপদবাবুকে নিয়ে। বছর সত্তরের বৃদ্ধের দাবি, এ বছর ‘দোষ খণ্ডন’ করতে ছেলেকে জোড়া গণেশ পুজো করতে হবে। ফোনে বলেন, “অক্ষয় তৃতীয়া হল, বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া। ওই দিনই ত্রেতাযুগের সূচনা হয়েছিল। কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য দান করেছিলেন ওই দিনই। ওই দিনেই রাজা ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন। ওই দিন গঙ্গাস্নান করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। তবে ফের লকডাউনের ভয়ে এ বার পয়লা বৈশাখেই পুজো করে নেব। এতেই সব করোনা ধুয়ে-মুছে যাবে।”
চিকিৎসক কুণাল সরকার যদিও বললেন, “ঘট পুজো-ডাব পুজো নয়, ভ্যাকসিন আর সচেতনতাই মানুষকে বাঁচাতে পারে। সকলে ভেবে দেখুন, হালখাতা করার হাল এর পরে থাকবে তো? তাই করোনার হাল বুঝেই হোক হালখাতা।” চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার আবার বললেন, “দয়া করে যে কোনও মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে গিয়ে পুজো করার অনুরোধ রইল। দোকানে দোকানে ঘুরে, ভিড়ে মিষ্টিমুখ করে যাঁরা নববর্ষ পালন করবেন ভাবছেন, তাঁদের বলব নিজের আর পরিবারের জন্য পরের পরিকল্পনাও করে রাখুন। শয্যা নেই হাসপাতালে হাসপাতালে।”
শিয়ালদহের কাগজের দোকানের মালিক নারায়ণ সরকার বললেন, “গত বছর সব ক্যালেন্ডার ফেলে দিতে হয়েছিল। গত বারের বহু কার্ড এ বার তারিখ বদলে দিয়ে যাচ্ছে। হালখাতা করা যাবে, ভাল কথা। কিন্তু পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া অনেক আসবে। এখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটাই অক্ষয় থাক।”