প্রতীকী ছবি।
বেআইনি বরাতের অভিযোগ তো ছিলই! কিন্তু বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে ‘উদাসীনতা’র পিছনে যে রয়েছে দুর্নীতির আরও অজস্র আখ্যান, মানছেন স্বাস্থ্য ও পরিবেশকর্তাদের বড় অংশ।
রাজ্যে সব মিলিয়ে প্রায় ৫২ হাজার শয্যার বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের দায়িত্ব। পরিষেবা দেওয়ার মূল্য দৈনিক শয্যা পিছু গড়ে আট টাকা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে এই ‘রেট’-এ ‘কনসোর্শিয়াম অব স্পেকট্রাম ওয়েস্ট সলিউশন অ্যান্ড এসএনজি মার্কেন্টাইল প্রাইভেট লিমিটেড’-কে ‘নিয়ম বহির্ভূত ভাবে’ বরাত দিয়েছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ওখানেই ঘটনাটির শেষ নয়! কারণ, গত বছরেরই নভেম্বরে আরও এক নির্দেশিকা বার করে স্বাস্থ্য দফতর। দেখা যায়, নতুন নির্দেশিকায় ৫২ হাজার শয্যার পরিবর্তে সাড়ে ৫৪ হাজার শয্যার বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের দায়িত্ব পেয়েছে এসএনজি। প্রতিদিন শয্যা পিছু গড়ে আট টাকার পরিবর্তে এ বার গড়ে ৮.৫০ টাকা হারে কাজ করতে শুরু করে তারা। ফলে আগে যেখানে মাসে এক কোটি ২৫ লক্ষ টাকা বিল করত সংশ্লিষ্ট সংস্থা, তা বেড়ে হয় প্রায় ১ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা!
প্রশাসনিক কর্তাদের একটি অংশের বক্তব্য, বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ ও তার প্রক্রিয়াকরণে ‘কমন বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট ফেসিলিটি অপারেটর্স’ (সিবিডব্লিউটিএফ) হিসেবে ওই সংস্থার এই রাজ্যে প্লান্ট এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র থাকার কথা। অথচ সে সব ছাড়াই ‘পাইয়ে দেওয়া’ ওই বরাতের কারণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে রাজ্যের কোষাগার থেকে প্রতি মাসে এত টাকা দিতে হচ্ছে!
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, দরপত্র ডাকার সময়ে বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য রাজ্যকে ১৩টি জ়োনে ভাগ করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। তার মধ্যে ন’টি জো়ন ছিল কোচবিহার, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, নদিয়া, হাওড়া, কলকাতা, পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ওই জ়োনগুলির মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, সাব ডিভিশন হাসপাতাল-সহ সমস্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ, নিয়ে যাওয়া ও তার প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্ব পেয়েছিল এসএনজি সংস্থা। মোট শয্যা ছিল ৫২,০২৬। বাকি চারটি জ়োনের দায়িত্ব পায় রাজ্যের ছ’টি স্বীকৃত সিবিডব্লিউটিএফ-এর মধ্যে ‘মেডিকেয়ার এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সিবিডব্লিউটিএফ।
কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসএনজি এবং মেডিকেয়ার সংস্থা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আটটি জ়োনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক এলাকা পরিবর্তনের আবেদন জানায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য দফতর গত বছরের নভেম্বরে ‘সোয়াপিং অ্যারেঞ্জমেন্ট অর্ডার’ও বার করে। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, এসএনজি সংস্থা এ বার মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া ও উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্ব পায়। এই চারটি পরিবর্তিত এলাকার সঙ্গেই আগের কোচবিহার, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, হাওড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও তারা পরিষেবা দিতে থাকে। এই পরিবর্তনের পরে এসএনজি-র অধীনস্থ ৫২ হাজার শয্যা বেড়ে হয় ৫৪,৫১৬। পরিষেবা মূল্যও দৈনিক শয্যা পিছু বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ৮.৫০ টাকা। কিন্তু বেআইনি ভাবে বরাত দেওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মুনাফা বাড়াতেই নতুন নির্দেশিকা কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে প্রশাসনিক মহলে।
আরও পড়ুন: করোনার উৎস খুঁজতে জানুয়ারিতে চিনে যাবে হু-র তদন্তকারী দল
যদিও মুনাফা বাড়ার বিষয়টি মানতে চায়নি দুই সংস্থাই। পারস্পরিক ওই ‘সমঝোতা’-র কারণ ব্যাখ্যা করে মেডিকেয়ারের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) কৃষ্ণেন্দু দত্ত বলেন, ‘‘এসএনজি-র কোনও প্লান্ট নেই। তাই ওরা বিল কাটলেও পরিষেবা আমরাই দিচ্ছি। বলতে পারেন, আউটসোর্স করেছি। যেখানে আমাদের নিজস্ব প্লান্ট রয়েছে, সেখানে পারস্পরিক এলাকা পরিবর্তনে রাজি হয়েছি।’’ আর যে সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই এসএনজি-র ডিরেক্টর এস পি সিংহ বলেন, ‘‘বিল শুধু আমরা কাটছি। কিন্তু প্রায় পুরো টাকাই মেডিকেয়ারকে দিচ্ছি।’’
আরও পড়ুন: করোনার কোপ শীত-পোশাকের ভুটিয়াবাজারেও
প্রশাসনিক কর্তাদের বক্তব্য, যে সংস্থার বরাতই পাওয়ার কথা নয়, তারা তা পেয়েছে। পাশাপাশি এটা খুবই আশ্চর্যের যে ‘অপারেটর’ হিসেবে দরপত্রে নির্বাচিত সংস্থা পরিষেবার বিল কেটে অন্য সংস্থাকে টাকা দিচ্ছে! প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র, প্লান্ট ছাড়াই ‘অপারেটর’ হিসেবে এসএনজি যে কাজ করছে, সে ক্ষেত্রে কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে? রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের উত্তর, ‘‘যদি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা ঠিক সময়েই জেনে যাবেন।’’