Pavlov Hospital

পাভলভ থেকে ফিরে মায়ের পাশে

চল্লিশোর্ধ্ব বিদেশের দাদা স্বদেশ মণ্ডল মুম্বইয়ে সরকারি চাকরি করেন। লকডাউনের মধ্যে আসার উপায় নেই।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২০ ০৩:১০
Share:

ফাইল চিত্র।

ঘরে ফেরা আর ঘরে থাকা নিয়ে টানাপড়েনের দেশে তাঁর ফেরাটাও ডুবে ছিল অনিশ্চয়তায়। কে ফেরাবে? কী ভাবে ফিরবেন? প্রশ্নগুলো খচখচ করছিল।

Advertisement

মহানগরের মানসিক হাসপাতালের পুরনো আবাসিক, জীবনের মূল স্রোত থেকে ছিটকে যাওয়া সেই যুবকই এখন বাড়ির লোকের সব থেকে বড় ভরসা। বৃদ্ধা মায়ের জীবন আর মৃত্যুর মাঝে এ ছেলের ফিরতে পারাটাই প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচমকা চোখে অন্ধকার দেখে নদিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার বাড়িতে মা পড়ে গিয়েছেন। খবরটা জনৈক প্রতিবেশিনী মারফত পেয়েছিলেন বিদেশ মণ্ডল। তখন তিনি পাভলভ মানসিক হাসপাতালের ওয়ার্ডে। বৃদ্ধ বাবা শয্যাশায়ী। যে ভাবেই হোক, মায়ের পাশে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ছেলে।

চল্লিশোর্ধ্ব বিদেশের দাদা স্বদেশ মণ্ডল মুম্বইয়ে সরকারি চাকরি করেন। লকডাউনের মধ্যে আসার উপায় নেই। ফোনে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকিয়ে এক আত্মীয়ের সাহায্যে বহু কষ্টে মাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তিনিও বোঝেন, এমন বিপদে ভাইটা পাশে না-থাকলে গতি নেই। কিন্তু সরকারি মানসিক হাসপাতালের নিয়মকানুনে বিস্তর জটিলতা। করোনা-আতঙ্কের জেরে সংক্রমণ ঠেকাতে সুপ্রিম কোর্টও মানসিক হাসপাতাল বা সরকারি হোমগুলি থেকে তুলনায় সুস্থ আবাসিকদের বাড়ি পাঠাতে বলেছে। কিন্তু নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, সুস্থদের বাড়ি ফেরানোর রিভিউ বোর্ড গড়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে রাজ্য। পাভলভে ২৫০ জনকে রাখার মতো বন্দোবস্ত থাকলেও রাখতে হয়েছে প্রায় তিন গুণ, ৬৭০ জন আবাসিককে। রাজ্যের সব মানসিক হাসপাতালেই গাদাগাদি, ঘেঁষাঘেঁষিতে তেঁতুলপাতায় ন’জনের সংস্কৃতি।

Advertisement

এ যাত্রায় বিদেশের সহায় হন মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দিদিরা। হাসপাতালে সাইকায়াট্রি বিভাগের প্রধান সৃজিত ঘোষ বলেন, “সাধারণত, কাউকে হাসপাতাল থেকে ছাড়তে বাড়ির লোকের সই লাগে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেই বিদেশবাবুকে ছাড়া হয়েছে।” তাঁর মতে, পাভলভের অন্তত ১৫০ জন রোগী সুস্থ। পরিবারের সঙ্গে তাঁরা অনায়াসে থাকতে পারতেন। পাভলভে ক্যান্টিনের নানা কাজ দিব্যি সামলাতেন বিদেশও। তাঁর দাদা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকিয়ে লকডাউনে অচল রাজ্যে বিদেশের ফেরার বন্দোবস্ত করেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক শুক্লা দাসবড়ুয়া। গত শুক্রবার সকালে কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধকালীন তৎপরতার পরে ওই যুবককে নিয়ে গিয়ে কল্যাণীতে জওহরলাল নেহরু হাসপাতালে (যেখানে বিদেশের মা চিকিৎসাধীন) নামানো হয়। কাজ চালানোর মতো কিছু টাকাও দেওয়া হয় তাঁর হাতে।

কল্যাণীর ওই হাসপাতাল সূত্রের খবর, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলেও বিদেশের মা ওষুধে সাড়া দিচ্ছেন। ছোট ছেলেই তাঁর সব খবরাখবর নিচ্ছেন, দাদাকে জানাচ্ছেন। স্বদেশবাবু বলছিলেন, “কিছু কু-অভ্যাসের কারণে ভাইকে আগে বাড়িতে রাখতে সমস্যা হত। কিন্তু বিপদে দায়িত্ব নিতে ও যে কারও থেকে কম নয়, তা বুঝিয়ে ছাড়ল।”

সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করেন, মানসিক রোগীদের ‘অযোগ্য’ তকমা দিয়ে তাচ্ছিল্য করা বা ওঁরা কিছুই পারেন না ভেবে কিছু করতে না দেওয়া— দুটোই অসম্মানজনক। “এই ঘটনাটি বোঝাচ্ছে, মানসিক হাসপাতাল থেকে আবাসিকদের ছাড়ার রীতিতে কেন বদল দরকার,” বলছেন তিনি।

স্থানীয় মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে কল্যাণীর হাসপাতালেই মায়ের অপেক্ষায় দিন-রাত কাটছে বিদেশের। নিজের ওষুধও খাচ্ছেন। তবে কখন ডাক পড়বে ভেবে রাতের ঘুমের ওষুধটা শুধু বাদ রাখছেন বিদেশ। সহাস্যে বলছেন, “লকডাউন সুযোগ দিল, তাই চট করে ছাড়া পেয়েছি। মাকে বলেছি, আমি আছি। আর চিন্তা নেই তোমার।”

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement