উত্সবের রঙিন বাজার একেবারেই স্তব্ধ। মন্দা শেষকৃত্যের বাজারেও।
সকাল ১০টা। কেওড়াতলা শ্মশান। মূল গেটে ঢোকার মুখে গার্ডরেল বসিয়ে দিয়েছে পুলিশ। দেওয়ালে নোটিস। একটি মৃতদেহের সঙ্গে চারজনের বেশি ঢোকা নিষেধ।
ভিতরে ঢুকেও এক অচেনা কেওড়াতলা। ডিসপ্লে বোর্ডে দু’টি আলো লাল। বাকি সবকটা সবুজ। মানে চারটে চুল্লি খালি। খাঁ খাঁ করছে বন্ধ কোলাপসিবল গেটের বাইরের চাতাল। যেখানে লাইন দিয়ে শোয়ানো থাকে দেহ। আজ একদম খালি। এক কোণে শুধু ডাঁই করে রাখা কিছু সাদা ফুলের রিং আর বালিশ। উঁচু চাতালের সিঁড়ির নীচে বসার জায়গা। অনেকগুলো পাখা বনবন করে ঘুরে যাচ্ছে মাথার উপরে। বাঁধানো বেদিতে দূরে দূরে বসে ঝিমোচ্ছেন জনা তিনেক। হাই তুলছেন। এঁরা মৃতদের বাড়ির লোক।
চুল্লির গেটের কাছাকাছি গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে, রুমালে মুখ ঢাকা এক যুবক কোলাপসিবল গেট ঠেলে বেরিয়ে এলেন— ‘কাউকে খুঁজছেন?’ পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম— মৃতদেহ কি কম আসছে নাকি? মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে যুবক বললেন, “ঠিকই বলেছেন। লকডাউন ঘোষণার কয়েক দিন পর থেকেই ডেডবডি কম আসছে। আজ সবে দু’টো ঢুকিয়েছি। অবশ্য একটা ভিআইপি বডিও এসেছিল।” যুবকের নাম চন্দন মালিক।
বাইরের চত্বরে মোবাইলে তাস খেলছিলেন সুরজ। প্রশ্ন শুনে আমার দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন, “আগে দাদা প্রতি দিন ৬০-৭০টা বডি আসত। এখন ২৫-৩০এর বেশি হচ্ছে না। যা আসছে সব লোকাল।”
হ্যাঁ, কেওড়াতলা থেকে নিমতলা, সিরিটি থেকে গড়িয়া শ্মশান— সর্বত্রই গিয়ে এই একই কথা শুনতে হল। করোনার করাল ছায়ায় যখন মৃত্যুভয়ে শীতল হয়ে আছে মহানগর, তখন তারই সব মহাশ্মশানঘাটে আচমকা কমে গিয়েছে মৃত্যুর স্পর্শ। কমে গিয়েছে চোখে পড়ার মতো করে। আর এই শ্মশানভূমি ঘিরে যাঁদের জীবন আর জীবিকা, মৃতদেহের সংখ্যার সঙ্গেই তো তাঁদের দৈনন্দিন আয়ের ওঠানামা। কেমন আছেন এখন ওঁরা?
আরও পড়ুন: বাঙালি বিজ্ঞানীদের তৈরি ৫০০ টাকার কিট, দ্রুত করোনা পরীক্ষায় সক্ষম
ওই যে মানুষদুটো ভিআইপি চুল্লির বাইরে সিঁড়ির ধাপে বসে যেন আপন মনে গুটিয়ে আছেন, অন্য সময় হলে তাঁদের ছুটোছুটি চলতেই থাকে। এক জনের হাতে খবরের কাগজ। কিন্তু পড়ছেন না। অন্য জনও চুপচাপ বসে। পোশাক আর কপালে তিলকমাটির ছাপ দেখে বোঝা গেল, এঁরা পুরোহিতের কাজ করেন। পুরসভা থেকে ভাতা পান শ্মশানের পুরোহিতরা। কোথাও নাম দেওয়া হবে না, এই শর্তে কথা বলতে রাজি হলেন। মৃতদেহ আসছে না? “একেবারেই আসছে না। হাতেগোনা বলা যায়। আমরা তো অনেকে আছি। সরকারি যৎসামান্য টাকায় কি পেট চলে? দেহ এলে, শেষকৃত্যের কাজে কিছু রোজগার হয়। এক-দুটো মরা নিয়ে কি টানাটানি করব!”— বললেন ওঁদেরই একজন।
কেওড়াতলার বৈদ্যুতিক চুল্লির সামনে এমন দৃশ্য একেবারেই অচেনা।
প্রায় এক ছবি উত্তর কলকাতায় নিমতলা শ্মশানেও। দুপুর ২টো নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, ঢোকার মূল গেটে তালা। পিছনে গঙ্গার দিকের গেট দিয়ে মৃতদেহ ঢুকছে। কিন্তু সেখানেও কোলাপসিবল গেটটা টানা। এক রক্ষী মৃহদেহের সঙ্গে গুনে গুনে লোক ঢোকাচ্ছেন। ভিতরে সাকুল্যে তিনটি মৃতদেহ লম্বা বারান্দায়। কেওড়াতলার মতোই খাঁ খাঁ করছে নিমতলাও!
নিমতলায় দৈনিক মৃতদেহ আসার সংখ্যা কেওড়াতলার থেকে বেশি। এমনি সময় বাইরে শববাহী গাড়ির ভিড় লেগে থাকে। শীতকালে জায়গা দেওয়া যায় না। এক সিকিউরিটি অফিসার জানালেন, প্রতিদিন গড়ে একশোর উপরে মৃতদেহ আসত। এমনকি দেড়শোও হয়ে যায়। বিশেষত শীতকালে। কিন্তু এখন ৪০-৫০টির বেশি মৃতদেহ আসছে না।
চিতার কাঠ। গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে লকডাউনের পর থেকেই।
শ্মশান মানেই, তাকে ঘিরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে থাকে নানান মাপের বাজার। খাট, তোষক, চাদর, অশৌচের ধুতি-শাড়ি ইত্যাদি, শববাহী গাড়ি, চা-পান-সিগারেট-বিড়ি থেকে শুরু করে কচুরি-শিঙাড়া-মিষ্টির দোকান... আরও কত কিছু। এর অনেকটাই সরাসরি শ্মশান চত্বর ঘিরে থাকে। কিছু কিছু থাকে শহরের অন্যত্রও। এ শ্মশান থেকে ও শ্মশান ঘুরতে ঘুরতে এই সব কারবারের যে ছবিটা পাওয়া গেল, তা বেশ করুণ।
মাছি তাড়াচ্ছেন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা
বেলা ১১টা বেজে গিয়েছে। কেওড়াতলা শ্মশানের বাইরে তখন সবে দোকান খুলছেন ছোটু রায়। এত দেরি কেন? ঝাড়পোছ করতে করতেই ছোটু জানালেন, “বাজার নেই দাদা। তাই ধীরেসুস্থে আসছি। কেওড়াতলায় আমার মতো সাতটা দোকান। এমনিতে মরা আসছে অনেক কম। তার ওপর অনেকেই আগের মতো কেনাকাটি করছেন না। কোনও রকমে সারছেন।” মূলত ধুতি-শাড়ি বেচেন ছোটু। দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো লাভ ছিল। মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার। এখন তা ১০ হাজারের নীচে নেমে এসেছে। “বাড়িতে মা-বোন-ঠাকুমাকে নিয়ে সংসার। কী ভাবে যে চালাব বুঝতে পারছি না”— বেশ হতাশ লাগছিল ছোটুর গলা।
খরিদ্দার নেই, নিজের দোকানে এখন বেশির ভাগ সময় এমনই বসে থাকেন ছোটু রায়।
নিমতলার মেহবুব মণ্ডলের দোকানে ধুতি-শাড়ি যেমন আছে, সেই সঙ্গে ঘি-ধূপকাঠি ইত্যাদি অন্ত্যেষ্টির জন্যে যা লাগে সে সব জিনিসও রয়েছে। জানালেন, “ধুতি-চাদর-আসন-চাবি এ সব নিয়ে কাছা-র প্যাকেজ বিক্রি হয় ২২০ থেকে ৩০০ টাকায়। এক-একটায় লাভ ৩০ থেকে ৫০ টাকা। তা ছাড়া আলাদা ভাবেও শাড়ি, ধুতি বিক্রি হয়। যে যেমন চান। দিনে সব মিলিয়ে হাজার খানেক টাকা লাভ থাকত।” আর এখন? “অর্ধেক হয়ে গেছে”— বললেন মেহবুব।
খাট বিক্রি অর্ধেক
বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালের বাইরে খাট বেচেন কৃষ্ণপদ গোস্বামী। এলাকায় সবাই কেষ্ট বলে চেনেন এক ডাকে। যে কোনও সরকারি হাসপাতালের বাইরেই এমন ‘মরার খাট’-এর দোকান চোখে পড়ে। কৃষ্ণপদর আক্ষেপ, “এমনিতেই শববাহী গাড়ির জন্যে খাট বিক্রি কমে গিয়েছে অনেক দিন হল। তার ওপর এখন এই হাল। খুব খারাপ অবস্থা ব্যবসার।” কৃষ্ণপদরা দু’জন পার্টনার। দিন-রাত খোলা থাকে দোকান। “দিনে ১০-১২টা বিক্রি হত। এখন পাঁচ-ছ’টার বেশি নয়। এখন আরও বেশি লোক তো দেখছি কাচে ঢাকা গাড়িতে ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছে”— বললেন তিনি। কেমন আয় হয়? কৃষ্ণপদ জানালেন— খাটের সঙ্গে নামাবলি, ধূপ, কাপড় এ সব মিলিয়ে বেচলে লাভ একটু বেশি থাকে। এমনিতে এক একটা খাট গড়ে সাতশো টাকায় বিক্রি হয়। এখন এই মন্দার বাজারে সেই খাট কখনও পাঁচশোতেও ছেড়ে দিচ্ছেন। কত থাকে দিনের শেষে? “দিনে পনেরোশোর মতো। মানে মাসে ৪৫ হাজার। এখন সব মিলিয়ে মাসে ১০ হাজারও হচ্ছে না”— জানাচ্ছেন কেষ্ট। লাভের টাকা ভাগ হয় দুই পার্টনারের মধ্যে।
খরিদ্দার কম, দামও কমিয়ে দিতে হয়েছে। বেহালার খাট বিক্রেতা কৃষ্ণপদ গোস্বামী।
বেহালা বাজারের সামনেও একটা খাটের দোকান আছে। তিন জন মালিক। তাঁদেরই একজন সহদেব অধিকারীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে বেহালাতেই থাকেন। “কষ্টের কথা কী বলব দাদা... ছেলেটা একটা শপিং মলে কাজ করত। বন্ধ। এক পয়সা পাচ্ছে না। আমার এখন দিনে ৩০০ টাকা আয় করতেই হিমসিম। সংসার চালাতে পারছি না”— বলে যাচ্ছিলেন সহদেব। সহদেবদের দোকানে দিনে লাভ হাজার খানেকের মতো ছিল। এখন তার তিন ভাগের এক ভাগ। সেটাই ভাগ করে নিতে হচ্ছে তিন জনে।
ধুঁকছে শববাহী গাড়ির ব্যবসা
বেহালার খাট বিক্রেতা কেষ্ট তাঁদের ব্যবসা মার খাওয়ার জন্য আঙুল তুলেছিলেন শববাহী গাড়ির দিকে। সেখানে কী অবস্থা? সেই ’৯৭ সাল থেকে শববাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিজয়গড়ের বাসিন্দা কালীপদ পাল। কলকাতার যে কোনও জায়গা থেকেই তিনি এই পরিষেবা দিয়ে থাকেন। দু’রকম সমস্যায় পড়েছেন তিনি। একে গাড়ির চাহিদা কমেছে। অন্য দিকে কর্মচারীরা অনেকেই হাসপাতাল বা শ্মশানে যেতে রাজি নন। “কাউকে তো জোর করতে পারছি না এ অবস্থায়। যাঁরা কাজ করতে চাইছে করুক। কী আর করা যাবে...”, বললেন কালীপদ।
আরও পড়ুন: বাবার চিকিৎসার টাকায় বর্ধমানে দুঃস্থদের সেবা মহিলা কনস্টেবলের
চারটি শববাহী গাড়ি আছে কালীপদবাবুর। এসি এবং নন-এসি দু’ধরনেরই। দক্ষিণ এবং উত্তর কলকাতায় কেওড়াতলা বা নিমতলায় মৃতদেহ পৌঁছে দেওয়ার জন্যে ১০০০, ১২০০, ১৫০০ টাকা দূরত্ব অনুযায়ী নেওয়া হয়। খুব কম হলে ৮০০। চালক ছাড়াও একজন হেলপার থাকেন। কেমন লাভ থাকে? “একটি ট্রিপে তেল-মেনটেন্যান্স ইত্যাদি খরচ বাদ দিয়ে লাভ ২০০ টাকার মতো”— কালীপদ জানালেন— “দিনে ১৫ থেকে ২০টা কল আসত এত দিন। লকডাউনের পর মাত্র ৪ থেকে ৬টা কল আসছে।”
নিমতলা শ্মশানের সামনে সব দোকানপাট এখন একসঙ্গে নয়, পালা করে খুলছে।
মোটামুটি যা হিসেব পাওয়া গেল, তাতে মাসে লাখ-সওয়া লাখ লাভ ছিল ড্রাইভার-হেল্পারকে টাকা দেওয়ার আগে। এখন সেটা এক ঝটকায় ৩০-৩৫ হাজারে নেমে এসেছে। “তিন-চার জনকে মাইনে দিতেই তো হাজার তিরিশেক চলে যায়। হাতে কিছু থাকছে না”— বলছেন দীর্ঘ দিনের ব্যবসায়ী— “অনেক গরিব মানুষ থাকেন, সে ক্ষেত্রে প্রায় বিনা পয়সাতেও পরিষেবা দিতে হয়। ব্যবসাটা হত অ্যামুলেন্স সার্ভিসে। কিন্তু এসএসকেএম এবং বাঙ্গুরের মতো হাসপাতালে কেউ গাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে না। অ্যাম্বুল্যান্সটা পড়েই আছে। স্টাফদের যতটা পারছি মাইনে দিচ্ছি। কিন্তু কত দিন পারব জানি না।”
ফুল ব্যবসা
লেক মার্কেটের বাইরে পর পর চারটে ফুলের দোকান খোলা। গাড়ি দাঁড়াতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সব। কী লাগবে দাদা? এ দিকে আসুন, এ দিকে আসুন। কলকাতার রাস্তায় এমনটা শোনার অভিজ্ঞতা নতুন নয় একেবারেই। কিন্তু এত মরিয়া করুণ ডাক থাকে না।
এখন না হচ্ছে বিয়েবাড়ি, না হচ্ছে জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী-অন্নপ্রাশন ইত্যাদির পার্টি-অনুষ্ঠান। ফলে রোজকার বাড়ির পুজোর খুচরো ফুল বাদ দিলে যা বিক্রি হওয়ার কথা তা মৃতদেহের জন্য সাদা ফুল। সেখানেও করুণ অবস্থা। সর্বত্রই ফুলের বাজারে একই ছবি। বেহালা ফুল বাজারের বিক্রেতা অশোক দাসের কথায়, “মৃতদেহের জন্যে লোক কমই ফুল কেনেন। এখন তা-ও নেই। হাওড়়া ফুল মার্কেট থেকে মাল এনে পর্তা হচ্ছে না। সাদা ফুল হলুদ হয়ে যাচ্ছে।”
নিমতলা শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লির মূল গেট এখন বন্ধ, দেহ ঢোকানো হচ্ছে পিছনের গেট দিয়ে।
রজনীগন্ধার এক ডজনের দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। মালা ৫০, প্যাঁচানো মালা ৭০ থেকে ১০০, তোরা ৪০টাকা। মাল সব দোকানেই কমবেশি আছে। কিন্তু কেনার লোক নেই।
কতটা কমেছে আয়?
লেক মার্কেটের এক ফুল বিক্রেতার দেওয়া হিসেব— মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হত। কিন্তু এক ধাক্কায় তা ৫ থেকে ৮ হাজারে নেমে গিয়েছে। ফুল আনা, ফুলের বোকে-মালা ইত্যাদি তৈরি করার জন্যে একজন করে থাকেন। তাঁকে কম করে হাজার চারেক টাকা দিতে হয়। কী করে কর্মচারীদের টাকা দেবেন, আর কী করেই বা সংসার চালাবেন, কোনও কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
অন্যান্য
কলকাতা শহরে মৃত্যু বা মৃতদেহকে কেন্দ্র করে, শ্মশানকে ঘিরে সমস্ত ব্যবসারই এখন এমন হাল। দেহ কম। তার উপর লকডাউনের বিধিনিষেধে আর করোনা সংক্রমণের ভয়ে হাতে গোনা লোকজনই থাকছেন ম়ৃতদেহের সঙ্গে। শ্মশানযাত্রীদের, বিশেষত দূর থেকে আসাদের, চা-জলখাবার বিক্রির যে চালু দোকানপাট দেখে আমরা অভ্যস্ত, তা-ও এখন বন্ধ। চায়ের দোকানই বলুন বা মিষ্টি-নোনতা— নিমতলা থেকে কেওড়াতলা— সব ঝাঁপ বন্ধ। শুধু এই সব ব্যবসাই তো নয়, কত ছোটখাটো আয়ও জুড়ে থেকে শ্মশানের সঙ্গে। কেওড়াতলায় কাঠের চুল্লির পাশ দিয়ে যেতে হয় আদিগঙ্গার দিকে। সেখানে দুই কিশোর হাফ প্যান্ট পড়ে কাদামাটি নিয়ে গোল্লা পাকিয়ে রাখছে। ‘২০ টাকা দিন দাদা, নিয়ে যান’— কাছে যেতে দেখা গেল অনেকগুলো মাটির তাল পরপর সাজানো। অন্ত্যেষ্টিতে মাটিও লাগে। এতগুলো পড়়ে রয়েছে? কেউ নেয়নি? “না দাদা, এখন তো বেশি কেউ আসছেই না।” এখানে বিক্রি হবে না বুঝে গিয়ে, ওরা আবার বসে পড়ল গঙ্গার ঘাটে।
মৃত্যু কি কমে গিয়েছে?
কিন্তু মৃতদেহ কমে গেল কেন? সত্যিই কি কমে গিয়েছে মৃত্যু? নাকি কেওড়াতলা-নিমতলার মতো বড় শ্মশানগুলোতেই এই ছবি? এখনই হাতের কাছে কোনও পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু এই পর্বে মৃতের সংখ্যা কিছু ক্ষেত্রে যে কমছেই তা পরিষ্কার। যেমন পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু লকডাউন পর্বে প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। আত্মহত্যাও কমেছে। তা ছাড়া সার্বিক ভাবেই এই পর্যায়ে মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে তুলনামূলক বেশি সচেতন রয়েছেন। পরিবেশ দূষণ কমেছে। একটু দীর্ঘমেয়াদী সময়ে এগুলোও মৃত্যুর হার কমানোয় প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু তাতে কতটা মৃত্যু কমবে, সেটা এখনই তথ্য দিয়ে হাজির করার মতো পরিস্থিতি নেই।
কেওড়াতলা শ্মশানে কাঠের চুল্লির ঝাঁপ বন্ধ।
অন্য দিকে নিমতলা বা কেওড়াতলার মতো বড় শ্মশানে মৃতদেহ কম আসার কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কেওড়াতলার সুরজ যেমন বললেন, “সুন্দরবন থেকেও অনেক পরিবার এখানে পোড়াতে আসে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অনেক দূর দূর থেকে দলবল নিয়ে লোকজন আসত। এখন এমন কেউ নেই।”
কলকাতা থেকে দূরে থাকা এমন অনেক পরিবার আছে, যারা কেওড়াতলা অথবা নিমতলাতেই মৃতদেহ নিয়ে আসেন। তাঁরা অন্য কোথাও যান না। অনেকটা পারিবারিক প্রথার মতোই। “অনেক সময় মৃত্যুর আগে প্রিয়জনেরাও নিজের ইচ্ছের কথা বলে যান। মৃত্যুর পরে তাঁর ইচ্ছে রাখতে ছেলেমেয়েরা এই নিমতলায় নিয়ে আসেন পোড়াতে”— বলছিলেন নিমতলার এক প্রবীণ পুরোহিত। এই দূর থেকে আসা মৃতদেহ এখন পুরোটাই অনুপস্থিত।
এ ছাড়া কলকাতার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে জেলা থেকে রোগী আসার সংখ্যাও এখন কম। শুধু মাত্র করোনা আক্রান্ত এবং উপসর্গ আছে, এমন রোগীর চাপ এখন বেশি হাসপাতালগুলিতে। স্বাভাবিক হারে রোগী ভর্তি হচ্ছে না। শহরের হাসপাতালে রোগী মৃত্যু হলে, অনেক সময়েই পরিজনেরা এখানেই শেষকৃত্য করে বাড়ি ফিরতেন। সেটাও কমে গিয়েছে।
ফটো: সোমনাথ মণ্ডল, গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ