Coronavirus

ছোটদের জমানো টাকা হাসি ফোটাচ্ছে অসহায়দের মুখে

শুভঙ্করবাবু ও তাঁর কয়েক জন শিক্ষক-বন্ধু মিলে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই স্কুলটি। যে স্কুলের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল, পড়ুয়াদের মজ্জায় মূল্যবোধকে মিশিয়ে দেওয়া।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২০ ০৩:১৮
Share:

প্রতীকী ছবি

বিন্দু বিন্দু করেই সিন্ধু তৈরি হয়। বহু পুরনো এই প্রবাদ সত্যি করে দেখাল কচিকাঁচারা।

Advertisement

বাড়ি থেকে পাওয়া হাতখরচ থেকে মাত্র এক টাকা রোজ ফেলতে হবে স্কুলের ক্লাসঘরে রাখা বাক্সে। গত ১৩ বছর ধরে এটাই রেওয়াজ। আর পড়ুয়ারাও হাসিমুখে তা রপ্ত করে নিয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্কুলের তহবিলে প্রতিদিন জমানো একটি করে টাকা এখন ‘ধনরাশি’তে পরিণত। করোনার ভয়াবহতার সময়ে পড়ুয়াদের সেই সঞ্চয় থেকেই তাদেরই অনুরোধে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে এক লক্ষ টাকা অনুদান পাঠালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।

গল্পটা বলছিলেন ‘দাদান’। বাংলার শিক্ষাঙ্গনে এক সময়ের ডাকাবুকো মাস্টারমশাই তথা আশুতোষ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শুভঙ্কর চক্রবর্তী। টালিগঞ্জের ব্রহ্মপুরে নিভা আনন্দ বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কাছে তিনি এখন ওই নামেই পরিচিত। শুভঙ্করবাবু ও তাঁর কয়েক জন শিক্ষক-বন্ধু মিলে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই স্কুলটি। যে স্কুলের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল, পড়ুয়াদের মজ্জায় মূল্যবোধকে মিশিয়ে দেওয়া। শুভঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘মাত্র এক টাকা নিয়েও যে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সেটা প্রমাণ করেছে। আমরা সারা বছর স্কুলের তহবিলে এ ভাবে অর্থ জমিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে থাকি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থসাহায্য করতে এ বার ছাত্রছাত্রীরাই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল।’’

Advertisement

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, পড়ুয়াদের এই তহবিলের নাম ‘তিল তিল সঞ্চয় ভাণ্ডার’। শুভঙ্করবাবু বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের বলা হয়, বাবা-মায়ের থেকে চেয়ে নয়, তারা বাড়ি থেকে যা হাতখরচ পায় তা থেকে এক টাকা রোজ ক্লাসঘরে রাখা বাক্সে ফেলতে। এটাও তাদের বোঝানো হয় যে, তাদের দেওয়া এই একটি টাকা আরও অনেক মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আমি নিজে সারা জীবন মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তা জাগিয়ে তুলতে চাই। তাই এমন ব্যবস্থা।’’

করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় বিপুল অঙ্কের অর্থের সামনে এই এক লক্ষ টাকা যে বিশাল মহাসাগরে জলবিন্দুর মতো, সেটা বোঝেন স্কুল কর্তৃপক্ষও। এক শিক্ষক বলেন, ‘‘একটি একটি করে জলের ফোঁটাই তো সাগরকে সমৃদ্ধ করে। আমরা মনে করি, শুধু লেখাপড়া বা মোবাইলের জগতে আবদ্ধ না-থেকে পড়ুয়াদের এটা বুঝতে হবে, সমাজটা সকলকে নিয়ে তৈরি। নিজে ভাল থাকার পাশাপাশি ভাল রাখতে হবে অন্যকেও।’’

নিভা আনন্দ বিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে পড়ুয়া সংখ্যা আটশোর কিছু বেশি। কর্তৃপক্ষ জানান, প্রতিটি ক্লাসে একটি টিনের বাক্স রাখা থাকে। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই সেই বাক্সে এক টাকার একটি কয়েন ফেলে দেয়। তার পরে শুরু হয় ক্লাস। বছর শেষে সেই সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে জমে ৫০-৬০ হাজার টাকা। সেই টাকা খরচ হয় স্কুলের আশপাশের এলাকার গরিব, অসহায় মানুষদের চিকিৎসায়। ওই কাজেও সক্রিয় থাকে পড়ুয়ারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই তহবিলের টাকা থেকেই সাহায্য করা হয় আর্তদের।

গড়িয়ার বাসিন্দা, পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র করের দুই নাতনি নিভা আনন্দ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। সুভাষবাবুর কথায়, ‘‘ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য মানুষ এখন লড়াই করে। এই স্কুলে দেখলাম, ছোট থেকেই পড়ুয়াদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এক টাকা বড় কথা নয়। আসলে প্রতিদিন ওই একটি করে টাকা পড়ুয়াদের জমা দিতে বলে তাদের বোঝানো হচ্ছে, তাদের আশপাশে বহু অসহায় মানুষ রয়েছেন। পড়ুয়ারা যেন তাঁদের কথাও মনে রাখে।’’

রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্কুলের বাচ্চাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। বহু জায়গায় দেখছি, বিপদের সময়ে ছোট পড়ুয়াদের মধ্যে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এমন প্রস্তাবও আমাদের কাছে এসেছে যেখানে বাচ্চারা বলছে, তারা ছবি এঁকে দিচ্ছে। সেই ছবি বিক্রি করে যেন অর্থসাহায্য করা হয়।’’

নিভা আনন্দ বিদ্যালয় এখন তাই সর্বার্থেই হয়ে উঠেছে এক আনন্দধাম।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেনআপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement