সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের নর্থ গ্যালারিতে আয়োজিত হল চিত্রশিল্পী চন্দ্রশেখর আচার্যর অষ্টম একক প্রদর্শনী। প্রবীণ এই শিল্পীর আয়োজনে ছিল তিরিশ বছরের টেম্পারা, গোয়াশ-ওপেকধর্মী বাছাই ৭২টি চিত্রকর্ম। বেশির ভাগ ক্যানভাসের উপরে টেম্পারার কাজ ছাড়া প্রতিসম সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ছিল কটনের উপরে গোয়াশের কিছু টেকনিক।
বিষয়গুলিতে দিবাস্বপ্ন বা ফ্যান্টাসির দৃষ্টিতে উঠে এসেছে প্রাত্যহিক চাওয়া-পাওয়ার অলীক সুখ ও সম্পর্ক। প্রকৃতপক্ষে আমাদের আকাঙ্ক্ষার কোনও নিয়ন্ত্রণ রেখা নেই। ফলে যুক্ত হয় অবাস্তব কিছু উদ্ভট কল্পনা, যেমন চাঁদ নিয়ে আমাদের মায়াবী জগৎ। সেই চাঁদের ছায়া যখন একটি জলাশয়ে আছড়ে পড়ে অবিকল রূপ নিয়ে, সেটি বিভ্রমবশত হাতে পাওয়ার আনন্দে, পশুদের হাসির ভূমিকায় ফুটে ওঠে মালিকানার জয়। ছবিটিতে প্রকৃতির সরাসরি রূপ না থাকলেও, চাঁদের প্রতীকে ধরতে চেয়েছেন একটি বিশেষ তাৎপর্যর প্রকৃতিকে। আবার টেম্পারার ‘ম্যাসাজ’ ছবিটিতে চোখে ফুটে ওঠে আরামের সুখ। অসাধারণ বাঙ্ময় ছবি ‘হুইসপার’- কমলা, হলুদ, সবুজ ও সামান্য নীলের উঁকিঝুকিতে তন্ময় এক সম্পর্ক!
চিত্রপট নিজে বানানো ছাড়াও, রঙের ব্যবহারে তিনি গুঁড়ো রং মিশিয়ে ফ্ল্যাট ব্রাশে ছবির মেজাজ তৈরি করেন। দেখে অনুমান করা যায় অতি কাছের রং ইন্ডিয়ান রেড ছাড়াও কমলা, টার্কিশ ও আল্ট্রামেরিন ব্লু-র আকর্ষণ বেশ তীব্র। সুপ্ত কামনাকে কাব্যছন্দে গ্রথিত করার স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশিত সিরিজ়টির নাম, ‘ভার্সিফাইড ড্রিম’। ছবিগুলির ফর্ম এবং প্রায় বন্য রঙের উপস্থাপনে পাশ্চাত্য দেশের যুগান্তকারী অস্থিরতাময় আন্দোলনগুলির মিশ্রিত জোরালো ছাপ অলক্ষ্যেই হয়তো এসে পড়েছে শিল্পীর ছবিতে (বিশেষ করে প্রতিটি নাকের আকৃতিতে কিউবিজ়ম অনুসৃত হয়)। যদিও অজন্তা, বাংলার পটচিত্র এবং লোকশিল্প দ্বারা ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত শিল্পীর কয়েকটি ছবির রেখাপ্রধান সরলতা, ফর্ম সেই পথেই হাঁটার আভাস দেয়।
প্রসঙ্গত প্রখ্যাত শিল্পী অসিত পাল, বন্ধুর শিল্প নিয়ে বলেন, “জীবন ভিন্ন মোড় নিলেও, ভুলে যাওয়া স্বপ্নগুলি অব্যাহত থাকে। তাঁর মহিলারা তাই কাব্যিক, রোম্যান্টিক যেমন, তেমনই তারা জানে ভয়ঙ্কর জন্তুকেও কী ভাবে বশ করতে হয়। তাঁর চিত্রকর্ম কখনও ব্যঙ্গের মাধ্যমে, আবার হাস্যরসের মাধ্যমে মানুষের অভিজ্ঞতাকেধারণ করে।”
শিল্পী চন্দ্রশেখর আচার্য নিজের ফেলে আসা অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, “আসলে আমি টেম্পারা, গোয়াশে কাজ করতে খুব পছন্দ করি। জীবনে প্রথম ছোট ছোট কাজ শুরু করেছিলাম মায়ের ছেঁড়া কাপড় দিয়ে। ওই সময়ে গণেশ পাইনের সঙ্গে বসন্ত কেবিনে নিয়মিত আড্ডা হত। উনি নিজে ক্যানভাস তৈরি করা, রং তৈরি করা নিয়ে আলোচনা করতেন। সেই ইনস্পিরেশনে আমি অয়েল করা ছেড়ে দিয়ে, মার্কিন কাপড় কিনে ট্রিটমেন্ট করেগোয়াশ ধরি।”
ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ঢোকার বহু আগে থেকেই ছবির প্রতি নেশায় শিল্পীর যাতায়াত ছিল সর্বত্র। প্রসঙ্গত বলেন, “নিখিল বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর, অ্যাকাডেমিতে বিশাল এগজ়িবিশন হয়েছিল। তখন আমার ১৫/১৬ বছর বয়স। সেটা ভীষণ তাড়া করে বেরিয়েছিল আমায়। নিখিল বিশ্বাসের মতো ব্রাউন পেপারে বড় ড্রয়িং করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এবং হেয়ার স্কুলের মধ্যবর্তী সরু গলিতে সাত দিনের এগজ়িবিশন করি।”
শিল্পীর অতীতের সম্পদ এতটাই পুষ্ট যে, ছবিও যে সেই উত্তরণের দিকেই যাবে, এ আলোচনা এখানে নিরর্থক। কলকাতার শিল্প-ঐতিহ্যের পরম্পরায় সহজেই তাই এসে যায় শ্রদ্ধেয় ও নম্র শিল্পী চন্দ্রশেখর আচার্যর নাম। নিজস্ব স্টাইলের রকমফের বেশি না করে, রঙের মজা এবং অবদমিত ইচ্ছেকে তাই বারবার তিনি বার করে আনেন। যথাক্রমে ‘টু সিস্টার্স’, ‘দ্য লেডি অ্যান্ড ব্রোকেন মুন’, ‘ডেড মুন’, ‘রেস্ট ইন মুনলাইট’, ‘লাইভলিনেস’, ‘দ্য ভিলেজ বয়’, ‘হোয়াইট বার্ড থিঙ্কারস’ ইত্যাদি মাত্র দু’-তিন রকমের রং নিয়ে স্বপ্নের আঙ্গিকে আদিম নিরাবরণ সমাজকে তুলে ধরেছেন। সেখানে রয়েছে সম্পর্কের অবাধ গতি। শিল্পীর আরও কিছু ছবির উল্লেখ না করলেই নয়। যেমন ‘রেড ভাস’, ‘জাগলার’, ‘ম্যান উইথ মাফলার’, ‘অন্ধ বাঁশি বিক্রেতা’।
বাস্তবিকই ছবির অকৃত্রিম সহযোগিতা, প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সঙ্কট ছাড়িয়ে নিয়ে যায় নিষ্পাপ আদির কাছে। দর্শকের দরবারে তাই পূর্ণ আশ্বাস মেলে দিয়ে যায় এই প্রদর্শনীটি।