সহমর্মী: পথকুকুরদের খাওয়াচ্ছেন ঈপ্সিতা। নিজস্ব চিত্র
পাড়ার চায়ের দোকান, রেস্তরাঁ থেকেই এত দিন ভরপেট খাবার জুটত তাদের। ভ্যাটে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট বা বাড়ির এঁটোকাঁটাও ছিল ভরসা। কিন্তু লকডাউনের জেরে কয়েক দিন ধরে বন্ধ সেই সব রেস্তরাঁ, দোকানপাট। বাড়িতে উচ্ছিষ্টের পরিমাণও কমেছে। ফলে তালাবন্দি শহরে খাদ্য-সঙ্কটের মুখে পথের কুকুর-বেড়ালেরা।
এই অসময়ে সেই পথকুকুরদের খাওয়াতে তাই পথে নেমেছেন বহু পশুপ্রেমী। যেমন, হাওড়ার দানেশ শেখ লেনের বাসিন্দা কলেজ ছাত্রী ঈপ্সিতা রায়। প্রতিবেশীদের থেকে চেয়েচিন্তে জোগাড় করা ভাত আর বাজার থেকে কেনা মাংসের ছাঁট রান্না করে লকডাউনের মধ্যেও সাইকেলে বেরিয়ে পড়ছেন তিনি, পথকুকুরদের খাওয়াতে। বলছেন, ‘‘লকডাউনে সব হোটেল, রেস্তরাঁ বন্ধ। পুরসভা অধিকাংশ ভ্যাট তুলে দিয়েছে। পথকুকুরগুলো খাবে কী?’’ কিন্তু সংক্রমণের ভয়? তাঁর জবাব, ‘‘মাস্ক, হাতে দস্তানা পরে বেরোচ্ছি। ভয় করলে এদের দেখবে কে?’’ ভয় উড়িয়ে প্রতিদিন ভোরে পথকুকুরদের খাওয়াতে যাচ্ছেন সল্টলেকের বাসিন্দা শমীক কাঞ্জিলালও। বলছেন, ‘‘নিউ টাউনে একটা বাচ্চার শরীর খুব খারাপ। ওকে ওষুধ না খাওয়ালে ও মারা যাবে।’’ মুন দে নামে এক কুকুরপ্রেমী বলছেন, ‘‘লেক গার্ডেন্স এলাকায় যতটা পারছি পথকুকুরদের খাওয়াচ্ছি। তবে কয়েক জনের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। লকডাউন বলে ওরা যেন অভুক্ত না থাকে, সেটা আমাদেরই দেখতে হবে।’’
কিন্তু লকডাউনের মধ্যে কী ভাবে বেরোচ্ছেন তাঁরা? দময়ন্তী সেন নামে এক পশুপ্রেমী জানাচ্ছেন, কুকুর-বেড়ালদের খাওয়ানোর জন্য তাঁরা সঙ্গে রাখছেন সাংসদ মেনকা গাঁধীর চিঠির প্রতিলিপি। দময়ন্তীর কথায়, ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তার পশুপাখিদের খাবারের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তাই ওদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতেই ওঁরা পথে বেরিয়েছেন— এমন কথাই লেখা রয়েছে ওই চিঠিতে। পুলিশ প্রশ্ন করলে আমরা এই চিঠিটা দেখাচ্ছি।’’ বাড়ির আশপাশের পথকুকুরদের খাওয়ানোর আবেদন করে সোশ্যাল মিডিয়াতেও পোস্ট করছেন অনেকে।
লকডাউনের কারণে খাবার সঙ্কটে পড়েছে পাখিরাও। নিউ মার্কেট চত্বরে খাঁচায় রাখা বিভিন্ন প্রজাতির শতাধিক পাখির খাবারের জোগানে সমস্যা হচ্ছে— বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বেরিয়ে এমন অভিযোগ শোনেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে ওয়াটগঞ্জ থানার পুলিশ আধিকারিক অঞ্জন সেনের নেতৃত্বে পুলিশ ওই পাখিগুলিকে চিড়িয়াখানার পশু হাসপাতালে পাঠায়। সেখানেই আপাতত ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে থাকবে ওই পাখিরা।
তবে করোনা-আতঙ্ক দেখাচ্ছে উল্টো ছবিও। পশুদের থেকে যে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই, সে কথা আগেই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। তার পরেও শহরের একাধিক জায়গায় ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে পোষ্যেরা। কেউ বাড়ি থেকে বার করে দিচ্ছেন আদরের পোষ্যকে, কোথাও নিরীহ কুকুর-বেড়ালকে পাড়াছাড়া হতে বাধ্য করছেন অনেকে। বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ কলকাতার এক এলাকা থেকে ৩০টিরও বেশি বেড়াল তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কেন এ ভাবে ব্রাত্য হচ্ছে কুকুর-বেড়ালেরা? অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র বলছেন, ‘‘যে কোনও পশুরই যে মানুষের মতোই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, তা ভুলে যাওয়াতেই আজ এই অবস্থা। আমি ওদের খাওয়াতে যাই বলে এই সময়ে অনেকেরই সমস্যা হচ্ছে। আমায় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে!’’ এমন মানসিকতার নিন্দা করছেন পশুপ্রেমী হিসেবে পরিচিত, অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়ও। পশুপ্রেমী শমীক বলছেন, ‘‘সকলে দয়া করে বুঝুন, কুকুর-বেড়াল থেকে করোনা ছড়ানোর ভয় নেই। দয়া করে গুজব ছড়াবেন না।’’