নজরদারি: নৈশ কার্ফুর সময়ে গাড়িতে নাকা তল্লাশি পুলিশের। মঙ্গলবার, রুবি মোড়ে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘চার দিকে দাউদাউ করে আগুন ধরে গিয়েছে। তার হাত থেকে কে কত দূর বাঁচতে পারবেন, সেই অনিশ্চয়তায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ!’— অতিমারির আঁচে একের পর এক আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এমনটাই মনে করছে শহরের চিকিৎসক মহল। তাঁরা বিস্মিত আগামী ২২ জানুয়ারি কলকাতা সংলগ্ন বিধাননগর এবং জেলার অন্য চারটি পুর নির্বাচন নিয়েও। কারণ সকলেরই
মত, যে কোনও জমায়েত ‘ঘি’-এর কাজ করছে। আর চিকিৎসকদের মতে, সংক্রমণের আগুনে সেই ‘ঘি’ পড়লে আক্রান্ত বাড়বে, কমবে না।
রাজ্যের কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা, চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভাবা উচিত। তবে তা দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে সদর্থক ভাবনাচিন্তা হওয়া প্রয়োজন। যে ভাবে চার দিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, তাতে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যা-ই হোক না কেন, এত মানুষের সমাগম কোনও ভাবেই ঠিক নয়।’’ ২২ তারিখের নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন জমার শেষ দিন ছিল সোমবার। সেখানে কোভিড-বিধি হেলায় উড়িয়ে কেমন ভিড় হয়েছে, সেই ছবি দেখা গিয়েছে বিধাননগর থেকে অন্যত্র। ওই দিনই নির্বাচন কমিশন এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, ভোট-প্রচারে বন্ধ থাকবে রোড-শো এবং র্যালি। তবে বড় মাঠে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ আলাদা রেখে সর্বাধিক ৫০০ জনকে নিয়ে জনসভা করা যাবে। সভাগৃহে ৫০ শতাংশ আসন কিংবা সর্বাধিক ২০০ জনকে নিয়ে রাজনৈতিক সভা করা যাবে।
যা শুনে বিস্মিত চিকিৎসকেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘এটা তো অনেকটা ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে লোকাল ট্রেন চালানোর মতো হল। বিষয়টিতে নজরদারি করবে কে?’’ তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে বিধানসভা ভোটের সময়েও এমন বিভিন্ন বিধি জারি করা হয়েছিল। কিন্তু, তা মানা হয়েছিল কতটা?
নিয়ম যে মানা হয়নি, তার প্রমাণ মিলেছিল রাজ্যে অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়া থেকেই। বিধানসভা ভোটের প্রার্থী থেকে একাধিক নেতা করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন। তাঁদের কয়েক জন মারাও গিয়েছেন। শহরের এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘‘কলকাতা পুরভোটের সময়েও বার বার করে কোভিড-বিধি মেনে চলার জন্য সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু আদৌ তা হয়েছিল কি? হয়নি যে, তার ফলাফল তো এখন মিলছে।’’
চিকিৎসকেরা বারংবার বলছেন, এখন যত জন সংক্রমিত হচ্ছেন, তাঁদের সিংহভাগ উপসর্গহীন কিংবা মৃদু উপসর্গযুক্ত। যে কোনও জমায়েতে এমন মানুষ থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাতে সংক্রমণ বেশি মাত্রায় ছড়াবে, সেটাও বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য। কার্ডিয়োভাস্কুলার শল্য-চিকিৎসক কুণাল সরকারের কথায়, ‘‘ভোট কিংবা যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্ক কষা বাদ দিয়ে একটা বিষয় কিন্তু ভাবতে হবে। এই ধরনের কর্মসূচি অবধারিত ভাবে বহু মানুষকে একত্রিত করবে, এটাই মোদ্দা কথা। জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার মধ্যে এমন কর্মসূচি হতে পারে কি না, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তা দেখেই নির্দেশিকা দেওয়া উচিত।’’ তিনি-সহ অন্য চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, দেশে ওমিক্রন প্রবেশ করেছে দিল্লি ওমুম্বই দিয়ে। ওই দুই জায়গায় পজ়িটিভিটি রেট (সংক্রমণের হার) সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশ। সেখানে গয়ংগচ্ছ ভাবে চলায় রাজ্যে সংক্রমণের হার পৌঁছে গিয়েছে ১৫-১৭ শতাংশে। কলকাতায় তা প্রায় ৩২ শতাংশ!
কুণালবাবুর কথায়, ‘‘আগুনের বল রেখে তাতে হাত দিতে বলাহলে, কেউ রাজি হবেন না। কারণ, তার তাপ সহ্য করতে পারবেন না। তা হলে এই যে জনস্বাস্থ্যের পরিসংখ্যানগুলি সামনে রয়েছে, সেগুলি
কি শুধু খাতায়-কলমে? চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ যেমন সেটা দেখছেন, তেমনই নির্বাচনকমিশনের আধিকারিকেরাও দেখছেন। তা হলে কেন বিজ্ঞানভিত্তিক নির্দেশিকা হবে না? ভোটই হোক বা যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, জনস্বাস্থ্যের নিরিখেএত মানুষকে একসঙ্গে আনা উচিত নয়।’’
কিন্তু, সোমবারের মনোনয়ন পেশের ছবিতেই ভেঙেছে ‘উচিত’, ‘অনুচিত’-এর সেই বেড়া। আর তাতেই বাড়ছে আগামীর সংশয়।