—প্রতীকী ছবি।
এক বাড়িতে বাবা-মা ও ছেলে করোনায় আক্রান্ত। বাবার হাই সুগার। সদ্য রিপোর্ট পেয়েই এক বন্ধুকে টাকা দিয়ে পালস অক্সিমিটার, রক্তে শর্করা ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্র কিনে আনতে দিয়েছিলেন ছেলে। তার জন্য খরচ পড়েছিল মোট ৩৭০০ টাকা। দিন দশেকের মাথায় নিজের বাড়ির জন্য ওই একই জিনিস কিনতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল সেই বন্ধুর!
দিনভর হন্যে হয়ে ঘুরে তিনি দেখলেন, ১০ দিন আগে যে পালস অক্সিমিটার ১৭০০ টাকায় কিনেছেন, তারই এখন দাম সাড়ে চার হাজার টাকা! সুগার মাপার যন্ত্রের দাম হাঁকা হচ্ছে চার হাজার। সামান্য ভেপার নেওয়ার ৩০০ টাকার যন্ত্রের দাম চাওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকারও বেশি। থার্মোমিটারের দাম ১৫০০ টাকা! সব মিলিয়ে আগে কেনা ৩৭০০ টাকার জিনিসের দাম এখন গিয়ে ঠেকেছে প্রায় সাড়ে ন’হাজারে!
এই মুহূর্তে করোনার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত জিনিসের দাম শহরে এমনই আকাশছোঁয়া বলে অভিযোগ। শুধু অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই নয়, দিনভর ঘুরে বহু জায়গাতেই এর অধিকাংশ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বহু ক্ষেত্রেই এই সব নিয়ে কালোবাজারিও শুরু হয়ে গিয়েছে বলে দাবি। ওষুধের দোকানের মালিকদের বড় অংশ আবার জানাচ্ছেন, এর সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ওষুধও।
গত বছরের করোনা পরিস্থিতিতে একই রকম অবস্থা দেখা গিয়েছিল শহর জুড়ে। পালস অক্সিমিটার, থার্মোমিটারের পাশাপাশি মাস্ক নিয়েও এই ধরনের কালোবাজারির অভিযোগ উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া নির্দেশে এর পরে এ নিয়ে তৎপর হয় পুলিশের এনফোর্সমেন্ট শাখা। শহর জুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়। তবে এ বার তাদের সেই তৎপরতা এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি বলে অভিযোগ।
লেক টাউনের একটি ওষুধের দোকানের মালিক বললেন, “পালস অক্সিমিটার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে এটার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিছু দিন আগেও ৫০০ টাকায় কিনে ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এ বার সেই ডিস্ট্রিবিউটর একটা পালস অক্সিমিটারের জন্য এক হাজার টাকা করে চাইছেন। এ দিকে নকল পালস অক্সিমিটার বিক্রির দায়ে পুলিশের খপ্পরে পড়তে চাই না। এ নিয়ে কালোবাজারি হচ্ছে কি না, তা-ও তো জানি না। তাই এর সঙ্গে যুক্ত থাকব না ঠিক করেছি।” সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, “শুধু অক্সিমিটার কেন, ডক্সিসাইক্লিন, মন্টেক এল সি বা আইভারমেকটিনের মতো ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে না।” শ্যামবাজারের একটি ওষুধের দোকানের ম্যানেজার বিশ্বজিৎ ঘোষ আবার বললেন, “পুলিশের ভয়ে এ বার মাস্ক নিয়ে সে রকম কিছু হচ্ছে না। কিন্তু পালস অক্সিমিটার বা সুগার, প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে হাহাকার চলছে। গত চার দিন ধরে আমাদের কাছে একটাও অক্সিমিটার নেই। ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও পাচ্ছি না। কালোবাজারি না হলে এ জিনিস হয় না। পুলিশ-প্রশাসনেরই আরও সতর্ক হওয়া উচিত।”
পোস্তার একটি ওষুধের দোকানের মালিক শম্ভুনাথ রায় জানালেন, এমনিতে এক একটি সংস্থার জন্য জ়োনভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটর থাকে। তাদের থেকে ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রী কিনে ডিলারেরা দোকানে পৌঁছে দেয়। কিন্তু গত কয়েক দিনে সমস্ত ডিলার হাত তুলে দিয়েছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, যেখানে হয়তো দিনে এক হাজার অক্সিমিটারের চাহিদা ছিল, এখন সেখানেই দৈনিক চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারে। ফলে জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাগুলি। ওষুধের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, এই ভয়ে বেশি করে ওষুধ তুলে রাখতে গিয়েই স্টক ফাঁকা হয়ে রাতারাতি হাহাকার শুরু হয়েছে। একটি ওষুধ বিপণির হাজরা মোড়ের স্টোরের ম্যানেজার সতীশ ঘোষের অবশ্য দাবি, “এর চেয়েও বড় ভয়, ভুয়ো জিনিস বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া। পালস অক্সিমিটার বা অন্য যে কোনও যন্ত্রের বেশির ভাগই আসে চিন থেকে। কম দামে তা কিনে উপরে বড় সংস্থার স্টিকার লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। কোনওটা কাজ করে, কোনওটা এমন রিডিং দেয় যে চিকিৎসকেরও চোখ কপালে ওঠে। যেখানে অক্সিজেনের মাত্রা ৩০-এর নীচে নেমে গিয়েছে দেখাচ্ছে যন্ত্র, সেখানে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছেন সেই ব্যক্তি। গোটা বছর এ সব নিয়ে কেউ খোঁজ করতে আসে না। কিন্তু এখন অতিমারির সময়ে দিন কয়েকের মধ্যেই নজরদারি, ধরপাকড় শুরু হল বলে! তাই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না অনেকেই। তাতেই আরও আকাল বাড়ছে।”
লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার অবশ্য মন্তব্য, “গোটা বছরই নজরদারি চালানো হয়। এই করোনা পরিস্থিতিতে কালোবাজারি বাড়তে পারে ভেবে বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। দ্রুত নানা দোকানে হানা দেওয়া হবে।”