আলিপুর চিড়িয়াখানায় আসা অনেকেই পরেননি মাস্ক। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
‘‘কাল থেকে সব বন্ধ। আবার সেই আগের মতো কড়াকড়ি হচ্ছে। করোনা প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছে।’’ শীতের দুপুরের মিঠে রোদেও উত্তেজিত ভাবে কথাগুলো বলতে বলতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে আসছিলেন এক ব্যক্তি। আচমকা তাঁর পথ আটকালেন এক দম্পতি। কী ব্যাপার জেনে নিয়ে স্ত্রীকে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘কাল থেকে তো আর হবে না! তা হলে কী করবে? বরং আজই চিড়িয়াখানাটা ঘুরে নিই?’’ মুহূর্তে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত বদলে দম্পতি ছুটলেন চিড়িয়াখানার উদ্দেশে!
সচেতন বা সতর্ক হওয়ার লক্ষণ তো নেই-ই, উল্টে রাজ্য সরকারের বিধিনিষেধ ঘোষণার কথা কানে আসতেই আরও বেশি করে বছরের প্রথম রবিবার উদ্যাপনে মাতলেন পথে নামা অনেকেই। শেষ বেলায় ‘সব দেখার’ চেষ্টায় কার্যত লুটোপুটি খেল করোনার বিধিনিষেধ। এই সময়ে শীতের মরসুমের দর্শনীয় স্থানগুলিতে একই রকম মাস্কহীন জনতার ভিড় দেখা গেল। দূরত্ব-বিধি মেনে চলার ব্যাপার সেখানে ছিলই না। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ আবার আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘‘যাক! তার মানে আজ সন্ধ্যা সাতটায় ট্রেন বন্ধ হচ্ছে না! একটু দেরি করে ফিরলে তা হলে অসুবিধা নেই!’’
পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন বেশি ভিড় ছিল চিড়িয়াখানা এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, রবিবার দর্শক এসেছেন ৬২ হাজার। বিধাননগর এলাকার বিনোদন পার্কগুলিও ভিড়ের নিরিখে টক্কর দিয়েছে কলকাতার দর্শনীয় স্থানগুলিকে। হিডকো সূত্রের খবর, এ দিন ইকো পার্কে জনসমাগম হয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার। নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাটেও ছিল চেনা ভিড়।
ময়দান চত্বরের ভিড় থেকেই কলেজ পড়ুয়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় বলে ওঠেন, ‘‘প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল ৩ তারিখ কিছু একটা ঘোষণা হতে পারে। তাই ঘুরে নিয়েছি। বড়দিন, ৩১ তারিখ, ১ তারিখ কোনওটাই খারাপ ঘুরিনি। এ দিনও যত ঘুরলাম, তাতে আগামী চার মাস ঘরবন্দি থাকলেও দুঃখ হবে না!’’ বিকেলে পরিবার নিয়ে শহর দেখতে এসেছিলেন অনুজ বিশ্বাস। তিনিও বলেন, ‘‘বুঝেছিলাম আবার সব বন্ধ হবে। তাই আজ সবাইকে নিয়ে বেরিয়েছি। ভেবেছিলাম কালও ঘুরব। কিন্তু শুনছি, কাল থেকে সব বন্ধ হবে। তাই শেষ বেলায় যতটুকু দেখা যায় আর কী!’’
এ দিনও দূরত্ব-বিধি শিকেয় তুলে গঙ্গার পাড়ে ভিড় জমান কমবয়সিরা। বিকেলের পর থেকে সেই ভিড় খানিকটা বাড়ে। গঙ্গার পাড়ে বসে তনুশ্রী আচার্য নামে এক তরুণী বললেন, ‘‘কাল থেকে শুনছি সব বন্ধ। বছরের এই সময়ে বাড়ি বসে থাকলে চলে? অকারণ এই সব বিধিনিষেধ জারি হচ্ছে। তা ছাড়া করোনা কত বার হবে! এত ঘুরেছি আমি তাও যখন হয়নি, তা হলে আমার আর হবে না।’’ মিলেনিয়াম পার্কের কাছে আবার মোবাইলে রাজ্য প্রশাসনের বিধিনিষেধের খবর দেখতে দেখতে প্রবল উত্তেজিত সুকুমার ঘোষ নামে এক ব্যক্তি। বললেন, ‘‘লোকাল ট্রেনে যে ৫০ শতাংশই যাত্রী উঠেছে, এটা নিশ্চিত করবে কে? রাত দশটা অবধি বার খোলা অথচ ট্রেন চলবে সাতটা পর্যন্ত? যারা শহরতলিতে থাকি, ফিরব কী ভাবে?’’ পাশে বসা সঙ্গিনীর ভাবনা বিয়ের নিমন্ত্রিতের তালিকা থেকে বাদ পড়া নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘৫০ জনকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে। সামনে বেশ কয়েকটা বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণ ছিল। কোন-কোনটা থেকে বাদ পড়ব তা-ই ভাবছি!’’
কিন্তু এ সবের থেকেও তো এই মুহূর্তে জরুরি সংক্রমণ রোখা? বন্ধুদের পিকনিক সেরে ফেরার পথে প্রিন্সেপ ঘাটে এক তরুণের মন্তব্য, ‘‘সে সব দেখা যাবে। আপাতত চিন্তায় পড়েছি আগামী সপ্তাহের পিকনিকে কী করে যাব সেই নিয়ে!’’ একই রকম চিন্তার সুর ধর্মতলা মোড়ে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর। তিনি বললেন, ‘‘অনেকেই তো এখন ছুটিতে রয়েছেন। কী করে এই বিধিনিষেধের কড়াকড়ি সামাল দেওয়া হবে জানি না। এ মাসেই উত্তরবঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেটার কী হবে!’’