গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কলকাতায় কোভিড সংক্রমণ শীর্ষে উঠেছিল গত ২৩ জুলাই। ওই দিন নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৭৯৫। রোজকার সরকারি বুলেটিন কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ৮০০ ছুঁইছুঁই ওই অবস্থা থেকে দৈনিক সংক্রমণ নেমে আসে ৪৫০ থেকে ৫৫০-এর মধ্যে।
শহরে বাস চালু হয়েছিল মে মাসে। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ চালু হয় মেট্রো। ঘটনাচক্রে তার সপ্তাহখানেক পর থেকে কলকাতায় ফের বাড়তে শুরু করেছে কোভিড সংক্রমণ। গত মঙ্গলবার নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা সাড়ে ৭০০-র কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে আবার। এর জন্য কি মেট্রোই দায়ী?
শহরের চিকিৎসক মহল সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে কোনও মেট্রোরেলযোগ দেখছেন না। যেমন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ীকে এমন সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করতেই বললেন, “শহরে যত গণযানবাহন চলছে, তার মধ্যে মেট্রোতেই সতর্কতা সবচেয়ে বেশি। ভুলে যাচ্ছেন, মেট্রো চালু হওয়ার তিন দিন পর ছিল মহালয়া আর বিশ্বকর্মাপুজো। বিভিন্ন জায়গায় তর্পণের যে ভিড় হয়েছে, প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে যেভাবে লোকজন গঙ্গায় নেমেছেন, তা সংক্রমণ ছড়ানোর যথেষ্ট বড় কারণ হতেই পারে।”
আরও পড়ুন: যাত্রীদের জন্য সুখবর, শেষবেলাতেও রিজার্ভেশনের সুযোগ ১০ অক্টোবর থেকে
একা কৌশিকবাবু নন, যে চিকিৎসকদের সঙ্গে আমরা সাম্প্রতিক সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলেছি, তাঁরা সবাই উদ্বিগ্ন আসন্ন উৎসবের মরসুম এবং তার আগের বাজারহাট নিয়ে। তা ছাড়া, সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত সপ্তাহে দু’দিন করে লকডাউন হয়েছে রাজ্যে। ওই দিনগুলিতে প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে রাস্তাঘাট সুনসান ছিল। বন্ধ ছিল দোকানপাট। তাতে সংক্রমণের ‘চেন ব্রেক’ হয়েছে বলে দৃঢ় ভাবেই মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। ইতিমধ্যেই মাস্ক পরায় অনীহা চোখে পড়ছে। ফিরেছে চায়ের দোকানে ভিড়। লোকাল ট্রেন বন্ধ, সে কারণে বাসে ঠাসা ভিড়। যত সিট, তত যাত্রীর এই ফর্মুলা কোথাওই মানা হচ্ছে না। অফিস টাইমে তো বাদুড় ঝোলা ভিড়ও নজরে পড়ছে রোজ।
এ বার মহালয়ায় কলকাতার বাবুঘাটে তর্পণের ভিড়। ছবি: পিটিআই।
এ বার পুজোর বাজারের ভিড় এখনও পুরোপুরি জমেনি। তাতেই বিভিন্ন বাজারে, বিভিন্ন দোকান বা শো-রুমে এমন ভিড়ের ছবি আসছে যা বিপজ্জনক হিসেবেই দেখছেন চিকিৎসকরা। ধর্মতলায় একটি নামী জুতোর দোকানে ভিড়ের ছবি ইতিমধ্যে ভাইরালও হয়েছে। কলকাতার ফুলবাজার দেখে আঁতকে উঠেছেন অনেকেই। শ্যামবাজার থেকে নিউ মার্কেট — দূরত্ব বিধি শিকেয়।
আরও পড়ুন: ২৮ দিন পর মুক্তি, জেল থেকে বেরোলেন রিয়া চক্রবর্তী
এটা চলতে থাকলে বড় বিপদ আসছে সামনে। বলছেন চিকিত্সকরা। কৌশিক লাহিড়ীর সতর্কতা— “কেরলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ওনাম-র উদাহরণ ভুলে যাবেন না। ১ সেপ্টেম্বর যেখানে কেরলে দৈনিক ১১০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন, ঠিক এক মাস পর, ১ অক্টোবর সেই সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছে ৯ হাজারের ঘরে। প্রায় সাড়ে সাতশো শতাংশ বৃদ্ধি! আমাদের এখানেও পুজো হবে নিশ্চয়ই। তবে আমাদের সতর্কও হতেই হবে। না হলে করোনার সুনামি আসবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে পরিস্থিতি।”
চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের কথায়: “মার্চ মাস থেকে করোনার যুদ্ধে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছি। অবৈজ্ঞানিক ভাবে পুজোর কেনাকাটা এবং ওই সময়ে ঘুরে বেরানোর সময় সতর্ক থাকা উচিত।”
নিউ মার্কেটে পুজোর কেনাকাটার ভিড়। ছবি: পিটিআই।
শুধু দুর্গাপুজোই নয়, দশেরা-দীপাবলি-ছটপুজো-ক্রিসমাসের মতো উৎসব রয়েছে আগামী কয়েক মাসে। দুর্গাপুজো নিয়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পুজো উদ্যোক্তা এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কী ভাবে নিয়ম-বিধি মেনে পুজো করতে হবে তিনি তার দিক নির্দেশও করেন। এ বিষয় নবান্নের তরফে নির্দেশিকাও জারি হয়েছে। যদিও চিকিৎসক মহল মনে করছে, আরও সতর্কতা এবং প্রশাসনিক মহলে সক্রিয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস (ওয়েস্ট বেঙ্গল) চিঠি দিয়েছে। হীরালাল কোঙার এবং পুণ্যব্রত গুণের মতো চিকিৎসকেরা বলছেন, মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থী নিয়ে মাতামাতি আটকানো গিয়েছে। নবরাত্রিতে ঐতিহ্যশালী গর্বা নাচ বাতিল করেছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র সরকার। এখানেও সে ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
একই মত সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার। তিনি বলেন, “বিভিন্ন রাজ্যে উৎসব যদি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, এখানেও প্রশাসনের সর্বচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মাস্ক পরা, দূরত্ববিধি যদি পুজোয় না মানা হয়, তা হলে চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এমনিতেই ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন পরিষেবা দিতে গিয়ে। তার পর যদি করোনার সুনামি আছড়ে পড়ে কেরলের মতো, তা হলে কে ঠেকাবে এই বিপদ।”
প্রশাসনের উদ্দেশে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস (ওয়েস্ট বেঙ্গল)-এর পরামর্শ, পুজোয় যে কোনও উপায়ে জনস্রোত বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির বাইরে প্রতিটি নাগরিকের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতেই হবে।