—প্রতীকী ছবি।
রাজ্যে করোনার বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই চলছে নির্বাচন। ভোটের ডিউটিতে গিয়েছেন বহু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ভোট শেষে তাঁরা স্কুলে এলে তাঁদের সংস্পর্শে এসে পড়ুয়াদের বিপদ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে শিক্ষক সংগঠনগুলি। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফের স্কুল বন্ধ রাখার আর্জি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষা দফতরকে চিঠি দিয়েছে তারা। এর পাশাপাশি, আগামী ৪ মে থেকে শুরু হতে চলা আইসিএসই এবং সিবিএসই বোর্ডের দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা অনলাইনে করার দাবি জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছেন অভিভাবকদের একাংশ। যদিও এই বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি আইসিএসই এবং সিবিএসই বোর্ড।
পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নবকুমার কর্মকার জানান, ভোটের ডিউটিতে থাকা শিক্ষকেরা ভোটের দিন বহু মানুষের সংস্পর্শে আসবেন। এর পরে তাঁরা স্কুলে এলে পড়ুয়াদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভোটকর্মী-শিক্ষকদের ১৫ দিন কোয়রান্টিনে থাকার পক্ষে সওয়াল করছেন তিনি। সামনে বোর্ডের পরীক্ষা থাকায় এমনিতেই স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতি অনেক কম। তার পরিপ্রেক্ষিতে নবকুমারবাবু বলেন, ‘‘যেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এখনও খোলেনি, সেখানে শুধু অল্প সংখ্যক পড়ুয়ার জন্য স্কুল খুলে রাখার প্রয়োজন নেই। পঠনপাঠন অনলাইনেই চলতে পারে।’’
পরিস্থিতির গুরুত্ব মেনে নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসুও। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচনের ডিউটিতে সব ক্ষেত্রে কোভিড-বিধিও হয়তো মানা হয় না। ফলে এর পরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের সংস্পর্শে এলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকছেই। তা ছাড়া যে সব স্কুলে কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে, ভোট-পর্ব মিটে যাওয়ার পরে সেগুলি ভাল ভাবে জীবাণুমুক্ত করা না-হলে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকবে।’’ তবে সৌগতবাবু এ-ও মনে করছেন, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস আবার পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে স্কুলছুটের সমস্যা আরও বাড়বে। তাঁর মতে, ‘‘পড়ুয়াদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে সপ্তাহে অন্তত এক দিন করে স্কুলে আনানো যেতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন স্কুল ভাল ভাবে জীবাণুমুক্ত করা জরুরি।’’
পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অভিভাবকদের চিন্তা বাড়াচ্ছে অফলাইনে বোর্ডের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অনলাইনে পরীক্ষার পক্ষে সওয়াল করলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ী অভিভাবকদেরই আর একটি অংশ। সিবিএসই পরিচালিত কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক অভিজিৎ বসু বলেন, ‘‘সিবিএসই বোর্ডের অধীনস্থ বহু স্কুল এবং কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় রয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায়। ওই এলাকাগুলিতে ইন্টারনেট সংযোগও খুব দুর্বল। ওই সব স্কুলের পড়ুয়ারা কী ভাবে অনলাইনে পরীক্ষা দেবে?’’ আইসিএসই বোর্ড পরিচালিত একটি স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির এক পড়ুয়ার অভিভাবক অনিন্দিতা রায় বলেন, ‘‘বোর্ডের পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার দাবি সমর্থন করি না। আমার মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ইচ্ছে আছে। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় যদি অনলাইন পরীক্ষার ফলকে গুরুত্ব না দেয়, তা হলে কী হবে?’’ পাশাপাশি, অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে ক্যামেরা চালু রেখে গার্ড দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্নও তুলছেন অনিন্দিতাদেবী।
যদিও যাঁরা অনলাইনে পরীক্ষার পক্ষে তাঁরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই প্রায় দেড় লক্ষ অভিভাবক তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। অনেকে টুইট করেছেন। স্বাক্ষরকারীদের বক্তব্য, যে ভাবে করোনার দাপট বাড়ছে, তাতে অনেক রাজ্যে নতুন করে লকডাউন জারি করতে হয়েছে। এই অবস্থায় পরীক্ষার্থীরা কী ভাবে স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দেবে? দ্বাদশ শ্রেণির এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণার পরপরই তো পরীক্ষা শুরু। এই অবস্থায় গণপরিবহণে কী ভাবে ছেলেকে পরীক্ষা দিতে পাঠাব? তাই অনলাইনে পরীক্ষার পক্ষেই সই করেছি।’’
কোনও কোনও অভিভাবক পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, মে-জুন মাসে যখন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক হবে, সেই সময়েই নেওয়া হোক সিবিএসই এবং আইসিএসই পরীক্ষা। যদিও কারও কারও মতে, তখন যে করোনা পরিস্থিতি পরীক্ষার অনুকূলে থাকবে, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? একই সঙ্গে বর্তমানে সংক্রমণের যা অবস্থা, সে দিক থেকে বিচার করলে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক অফলাইনেই বা কী ভাবে নেওয়া সম্ভব, সেই চিন্তায় ভুগছেন অভিভাবকদের একটি অংশ।
কলকাতার আইসিএসই এবং সিবিএসই বোর্ডের অধীন কিছু স্কুলের প্রিন্সিপালেরা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি দুই বোর্ডের কর্তারা পরীক্ষা নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। প্রিন্সিপালেরা বলেন, ‘‘অনলাইনে পরীক্ষা হবে না অফলাইনে, না কি টেস্টের ফল দেখে পরীক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়া হবে— সেই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’’
সব মিলিয়ে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় শিক্ষক এবং অভিভাবক মহল— উভয় পক্ষই।