ছবি পিটিআই।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে, ১৯৬৫ সালে কয়েক দিনের জন্য শহরে ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়েছিল। তখন আমার বছর তিরিশ বয়স হবে। অর্থাৎ, এখন থেকে বছর পঞ্চান্ন আগে। আমার এখন পঁচাশি বছর বয়স। সে সময়ের কয়েকটি টুকরো-টুকরো ঘটনার কথা মনে রয়েছে। তবে যে হেতু পুরোটাই স্মৃতি থেকে বলা, তাই কোথাও কোনও ভ্রান্তি বা সময়ের এ দিক-ও দিক হলেও হতে পারে। যাঁদের পুরোটাই মনে রয়েছে, তাঁরা হয়তো আরও বেশি ভাল বলতে পারতেন।
সে সময়ে কিছু দিনের জন্য কথাবার্তা সামলে বলতে হয়েছিল। কেমন যেন একটা ফিসফাস, চুপচাপ ভাব চার দিকে। তবে আমার আবার বরাবরই কথাবার্তা সামলে বলার ধাত নেই। ফলে প্রায় ফাঁকা কফি হাউসে বসে হয়তো আমি বলছি— ‘এ সব বানানো, তৈরি করা পরিস্থিতি। এগুলো আদৌ সত্যি নয়।’ তখন আমার বন্ধুবান্ধবেরাই চাপা স্বরে ধমকে থামিয়ে দিত আমাকে। বলত, ‘‘আপনি থামুন তো মশাই। এ সব আপনি বলছেন, আর পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে!’’ তা ধমক-টমক খেয়ে বন্ধুবান্ধবদের জন্যই শেষে চুপ করতে হত আর কী! আবার অনেক সময়ে এমনও হত যে, বন্ধুদের মধ্যেই তর্কাতর্কি লেগে যেত।
শহরের যে নিজস্ব ছন্দ, নিজস্ব গতি ছিল, সেটাই তখন কেমন যেন ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছিল। কেমন একটা ‘ক্লসট্রোফোবিক’, দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। জমায়েত, ভিড় বলতে কিচ্ছু ছিল না। সব সুনসান। ফাঁকা। যাঁরা তার মধ্যেই জরুরি কোনও কারণে বাইরে বেরোতেন, তাঁরাও দ্রুত ঘরে ফিরে আসতেন। রাস্তা যাতে অন্ধকার থাকে, তাই রাস্তার আলোগুলো কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত। তখন জনমানসে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছিল। তা হল, অনেকের মধ্যেই একটা ছদ্ম দেশপ্রেম তৈরি হয়েছিল। অনেক সময়েই তার মাত্রা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যে, সেটা বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিল। মানে এমনিতে দেশপ্রেম জাগছে না, যুদ্ধ করেই জাগুক আর কী!
সে সময়ের সব থেকে খারাপ স্মৃতি, যখন গ্রামের লোকেরা শহরের রাস্তায় ফ্যান চাইতে বেরোতেন। ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও’ বলে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। আসলে যে কোনও ধরনের যুদ্ধেই তো সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন সেই প্রান্তিক মানুষেরাই। সে কোনও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধই হোক বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ক্ষতি সব থেকে বেশি তাঁদেরই হয়!
এখন যেমন চার দিকে একটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব। এই বুঝি কিছু হল, কিছু হল, একটা আতঙ্ক। বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাজ বাড়িতে বসেই যতটা সম্ভব করতে বলা হচ্ছে। যাঁরা বাইরে বেরোচ্ছেন, তাঁরাও তো তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসছেন সে সময়ের মতোই। পার্থক্য শুধু একটা জায়গাতেই। তখন লড়াইটা ছিল শত্রু দেশের বিরুদ্ধে। আর আজকের লড়াই হল অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে, এক ভাইরাসের বিরুদ্ধে।