কথোপকথন: বাইপাসের একটি ক্লাবের আলোচনাসভায়। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
রোজ বন্ধুর সংখ্যা বাড়ান— পরামর্শটা এল আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।
শহরে-গ্রামে সে-ই বৃদ্ধ দম্পতিদের প্রতি এমন পরামর্শ, যাঁরা একাকিত্বে ভুগছেন। সম্প্রতি নেতাজিনগর এবং নরেন্দ্রপুরে এক বৃদ্ধ ও এক প্রবীণ দম্পতিকে খুনের ঘটনার পরে নড়ে বসেছে শহর। প্রশ্ন উঠেছে, বিদেশে বা ভিন্ রাজ্যে চাকুরিরত যুবক-যুবতীদের বাবা-মা, এই প্রবীণ ও বৃদ্ধ দম্পতিদের জন্য কতটা নিরাপদ কলকাতা?
‘এই শহরে প্রবীণেরা কতটা সুরক্ষিত?’ সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ শীর্ষক আলোচনায় সেই প্রশ্নই রাখা হয়েছিল বাইপাসের একটি ক্লাবে আগত বেশ কিছু প্রবীণ দম্পতির সামনে। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন শহরের নামী ব্যক্তিত্বরাও। আর সেখান থেকেই উঠে এসেছে বহু প্রশ্ন, অনেক পরামর্শ। আলোচনায় ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তাঁর সিনেমায় অভিনয় করা অনসূয়া মজুমদার, নাইজেল আকারা এবং মানালি মনীষা দে। ছিলেন কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় এবং মনোবিদ মোহিত রণদীপও।
শিবপ্রসাদের মায়ের বয়স এখন ৮৪। তিনি একা থাকেন বরাহনগরে। শিবপ্রসাদ বলেন, ‘‘বাবা মারা যাওয়ার পরে বাড়ির দখল নিতে এসেছিলেন ভাড়াটেরা। আমি, দাদা তখন ছোট। সন্ধিবাবু আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তিনি সে বার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। দাদা এখন অন্যত্র থাকেন, আমি টালিগঞ্জে। বরাহনগরে একা মা এখনও প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকেন। প্রাথমিক ভাবে সেই বিষয়টি নিয়েই আমার ছবি ‘গোত্র’।’’
দর্শকাসন থেকে শান্তনু ঝা জানালেন, তাঁর মা জলপাইগুড়িতে রয়েছেন এবং নিরাপদেই রয়েছেন। শান্তনুবাবুর উপলব্ধি— ‘‘আপনি যত মানুষকে ভালোবাসবেন, তত মানুষ আপনার পাশে থাকবে। আপনি আরও বেশি নিরাপদ বোধ করবেন।’’ মনোবিদ মোহিত রণদীপও মনে করেন, ‘‘আরও বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো দরকার। কমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশা দরকার। একের পর এক মৃত্যু সংবাদে এই বয়সের মানুষেরা বিপন্ন বোধ করেন। তাঁদের মানসিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।’’
সন্ধিবাবু বলছেন, ‘‘কলকাতা শহরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখভাল করার জন্য পুলিশের ‘প্রণাম’ বলে একটি প্রকল্প রয়েছে। তবে, তার প্রয়োজন নিত্য দিন বাড়ছে। প্রণামের উপরে মানুষের নির্ভরতাও বাড়ছে। আরও বড় আকারে সেই পরিষেবা পৌঁছে দিতে গেলে সরকারের আলাদা একটি দফতর খুব প্রয়োজন। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও কাজ করছে। তাদের নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করাটা জরুরি।’’
দর্শকদের মধ্যে থেকে সঙ্গীতা দত্ত বললেন, তিনি বৃদ্ধাবাসকে একটি সমাধান বলে মনে করেন। সঙ্গীতার কথায়, ‘‘বৃদ্ধাবাসে অনেক বেশি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকতে পারেন নিঃসঙ্গ দম্পতিরা।’’ অভিনেত্রী অনসূয়া আবার মনে করিয়ে দেন— ‘‘নিজের বাড়ি ছেড়ে অনেকেই বৃদ্ধাবাসে থাকতে চান না। তার চেয়ে সমাজ, পাড়া, ক্লাব এগিয়ে এলে ভাল।’’ অভিনেত্রী মানালি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘‘নিজেদের ব্যক্তিজীবনে বাইরের কোনও হস্তক্ষেপ আমরাই তো পছন্দ করি না। সেই কারণেই এত নিঃসঙ্গতা।’’
নেতাজিনগরে খুনের ঘটনায় এক রংমিস্ত্রিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ভবিষ্যতে বাড়িতে কোনও আয়া রাখার ক্ষেত্রে, মিস্ত্রিদের ডাকার ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন নাইজেল। বলেছেন, ‘‘প্রয়োজনে একটু বেশি টাকা খরচ করে নথিভুক্ত জায়গা থেকে পরিষেবা নেওয়াটা নিরাপত্তার দিক থেকেও জরুরি।’’