হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছেন মৃত রিমা সিংহের বাবা অরুণ সিংহ।
আচমকাই বুকে ঠেকেছিল বন্দুকের নল। হকচকিয়ে মুখ তুলতেই তরুণ দেখলেন, খাকি উর্দি পরা এক পুলিশকর্মী ‘এসএলআর’ তাক করে রয়েছেন। প্রথমে মজা ভাবলেও, পরক্ষণেই নিজেকে সরিয়ে নেন ওই তরুণ। তাতে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েই গুলি ছোড়েন ওই কনস্টেবল। সেই বুলেট সামনে থাকা একটি গাড়ির বনেটে লাগে। সেখান থেকেই কিছু একটা ছিটকে হাতে আঘাত পান ওই তরুণ। কোনও মতে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান তিনি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার থেকে বেরোনোর সময়েও সেই ঘটনার আতঙ্ক স্পষ্ট তরুণের চোখে-মুখে। ১৯ বছরের ওই তরুণ মহম্মদ সরফরাজ আলম বলেন, ‘‘মজা ভেবে অপেক্ষা করলে, আজই হয়তো শেষ হয়ে যেতাম!’’ অন্য দিকে, কাজে বেরিয়ে বেঘোরে মেয়েটার যে প্রাণটাই চলে গিয়েছে, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এসে তা মানতেই পারছিলেন না রিমা সিংহের বাবা অরুণ সিংহ। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের কাজ সেরে বেরোনোর সময়ে বিধ্বস্ত প্রৌঢ়কে তাই পুলিশকর্মীরাই ধরে ধরে গাড়িতে তুলে দেন।
এ দিন সন্ধ্যায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ আউটপোস্টের সামনে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে অনেকেই বলতে থাকেন, ‘‘এমন ঘটনা ভাবা যায় না। রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে তরতাজা মেয়েটা মরেই গেল!’’ একই রকমের আক্ষেপ শোনা গেল পিজির ট্রমা কেয়ারে চিকিৎসাধীন মহম্মদ বসির আলম নোমানির বন্ধু-পরিজনদের গলায়। তাঁদের কথায়, ‘‘নিজের কাজে যাচ্ছিলেন। অহেতুক গুলিবিদ্ধ হতে হল। ভাবাই যাচ্ছে না।’’ পার্ক সার্কাসের লোয়ার রেঞ্জ রোডে এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর ঘটনার পরে ওই পুলিশকর্মী ছোডুপ লেপচা এবং রিমা, সরফরাজ ও মহম্মদ বসির আলম নোমানিকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছোডুপ ও রিমাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
ডান কাঁধে গুলি লাগা, আটচল্লিশ বছরের মহম্মদ বসির এবং বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর ও ডান হাতের কব্জিতে ক্ষুদ্র কয়েকটি ক্ষত হওয়া সরফরাজকে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। বিকেল সওয়া চারটে নাগাদ কলকাতা পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্সে করেই দু’জনকে সেখানে আনা হয়। খবর পেয়ে দু’জনের পরিজন এবং পরিচিতেরাও হাসপাতালে চলে আসেন। সূত্রের খবর, বসিরের কাঁধে গুলি ঢোকার চিহ্ন থাকলেও, তা ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চিহ্ন শরীরের কোনও অংশে নেই। কার্ডিয়োথোরাসিক বিভাগের চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসা শুরু করেছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তিনি স্থিতিশীল রয়েছেন। আর গাড়ির বনেটে বুলেট লেগে ধাতব পদার্থ বা বারুদ ছিটকে হাতে আঘাত পাওয়া সরফরাজকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই তরুণের খুড়তুতো দাদা আতাহার হুসেন জানান, দিন চারেক আগে গয়া থেকে তাঁর রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছেন সরফরাজ। এ দিন দুপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তিনি লোয়ার রেঞ্জ রোডের গ্যারাজে গিয়েছিলেন। সরফরাজ বলেন, ‘‘গ্যারাজের সামনে গাছতলায় বসে ছিলাম। আচমকা দেখি, বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ওই কনস্টেবল। মজা ভেবে একটু সরে যেতেই উনিও একটু পিছিয়ে গিয়ে আমার দিকে গুলি চালালেন। সেটা পাশের গাড়িতে গিয়ে লাগে।’’ মুহূর্তের মধ্যে নিজের হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখে আতঙ্কে দৌড়ে গ্যারাজে ঢুকেই সংজ্ঞা হারান সরফরাজ। গ্যারাজের কর্মীরাই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। অন্য দিকে, কাঁধে গুলি লাগার পরে বসির নিজেই তাঁর বন্ধু কৌসর আলিকে ফোন করে ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন।
ট্রমা কেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কৌসর বলেন, ‘‘আচমকাই বসির ফোন করে বলে, ‘পিঠে গুলি লেগেছে’। কী হল বুঝতে পারছিলাম না। কিছু ক্ষণ পরে আবার ফোন করে বলল পুলিশ ওঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাচ্ছে।’’ পেশায় ব্যবসায়ী, কলিন স্ট্রিটের বাসিন্দা মহম্মদ বসির দুপুরে বাইক নিয়েয়ে রাজারহাটে যাচ্ছিলেন। কৌসর জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে বসিরকে বাইকে বসিয়েই তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ।
মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বিকেলে ন্যাশনাল মেডিক্যালে এসে সোজা জরুরি বিভাগে চলে যান রিমার বাবা অরুণবাবু। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ সেখান থেকে বেরোনোর সময়ে তিনি কথা বলতে চাননি। ভিড় এড়াতে পুলিশ আউটপোস্টের সামনে গাড়ি এনে তাতে প্রৌঢ়কে তুলে বাড়ি পাঠায়। রাতে ন্যাশনাল মেডিক্যালের মর্গেই রাখা হয় রিমা এবং ছোডুপের দেহ।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।