ফাইল চিত্র।
শৈশব থেকে এই শহরের বাসিন্দা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে উত্তরের আমহার্স্ট স্ট্রিটে আছি। দীর্ঘ সময়ে সাক্ষী থেকেছি অনেক বদলের। যার কিছু ভাল, কিছু মন্দ। যতটা যত্নের দরকার ছিল, ততটা পায়নি তিলোত্তমা। তাই সত্যিকারের তিলোত্তমা হল কোথায় আমার কলকাতা? এই না-পারাটাও আমাদের অবহেলায়।
যা ভাল ছিল, আর যা ভাল হল— সেটা পূর্ণতা পেত, যদি ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। আর জনপরিষেবার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে। শৈশবে আমার শহরে ছিল আলো-আঁধারির খেলা। রাত বাড়লেই রাজপথেও নামত অন্ধকার। জনসংখ্যা কম ছিল, মানুষ বেরোতেন কম। তাই অপরাধ হয়তো কম ঘটত বা ঘটলেও সামনে আসত না।
আর এখন? আলোয় ভাসছে গোটা শহর। তবু এত অপরাধ, নৃশংসতা কেন? নতুন আলোও বহু জায়গায় নষ্ট পড়ে থাকে। দৃশ্যমান সব। তা-ও যথা সময়ে সারানো হয় না। আমাদের ছোটবেলায় পার্ক কোথায়? উত্তর কলকাতার গলি-মহল্লায় খেলে বেড়ে উঠেছি। আজকাল তো পুরসভা কত সুন্দর সুন্দর পার্ক করে। অথচ সে সবের অনেকগুলোই বছর ঘুরতে অবহেলায় পড়ে থাকে।
মানতেই হবে, পানীয় জলের অভাব এখন অনেক কম। জনবিস্ফোরণ ঘটলেও শহরে কিন্তু পানীয় জলের পরিমাণ বেড়েছে। জলকষ্ট তেমন নেই বলেই জানি। কিন্তু জমা জল? বাড়ি থেকে হাঁটা পথে ঠনঠনিয়া। এই অঞ্চলে জল জমলে কী হত, আর এখন কী হয়— সবটাই আমার চোখে দেখা। আগে জল জমত। এখনও জমে। পার্থক্য, আগে যত দিনে নামত, এখন সেই সময়ে নামে না। তিন দিন পরেও জমে থাকে। অবশ্য পুরসভা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জল জমা আটকানোর চেষ্টা করেছে বলে শুনেছি। আসলে আগে এমন সমস্যা হলে পাড়ার ছেলেরাই নেতা বা তাঁদের চামচাদের ধরে ব্যবস্থা করত। এখন তো ‘পাড়ার ছেলেরাই’ হারিয়ে গিয়েছে। কাজ বা পড়ার সূত্রে পাড়াছাড়া ওই ছেলেদের অভাব খুব বোধ করি। অথচ পুর প্রতিনিধিদের এলাকায় দেখা যায়। কিন্তু পুর প্রশাসনিক কাজের গতি হারিয়েছে। আমার মনে হয়, প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে রাজনীতিকে না জড়ালেই ফের গতি আসত। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব?
আর রাস্তা? উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র হাড়গোড় বার করা রাস্তা আর ফুটপাত শহরের লজ্জা বাড়িয়ে দেয়। উত্তরের চেহারাটা করুণতম। গত কয়েক বছর ধরে রাস্তা বা ফুটপাতের মতো জরুরি বিষয়কে অবহেলা করার প্রবণতা অজানা কারণে বেড়েই চলেছে। কখনও বিদ্যুৎ, কখনও জল, কখনও নিকাশি, কখনও কেব্ল— যে যখন পারছে খুঁড়ে মাটির ঢিবি বানিয়ে চলে যাচ্ছে। সে রাস্তা আদৌ সারানো হল কি না, খোঁজ রাখেন না কেউ। আগে দেখতাম, মন্দির তুলে ফুটপাত দখলের গল্প। আজকাল দেখি, থানার গা ঘেঁষেই ফুটপাতে ঘর ওঠে। চলে ক্যারমের লড়াই। শুনি, সবটা ‘সেটিং’ করা থাকে। মানিকতলা, রাজাবাজার, লোহাপট্টির ফুটপাত ঘুরলে স্পষ্ট হয়ে যায় ছবিটা।
বাড়ছে গাড়ি। বয়স্ক আর শিশুদের পক্ষে খুব কষ্টকর ওই ফুটপাত ছেড়ে ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া। কিন্তু ওঁদের কথা ভাববে কে?
যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বহুতল, এ শহরের আর এক রোগ। সরু গলি বা বস্তিতে এমন বাড়ি করার অনুমোদন দিতে প্রশাসনকে অনেকটাই সতর্ক হতে হবে। আর অবৈধ পার্কিং! যেখানে খুশি ফেলে রাখা গাড়ি যেমন যানজটের কারণ, তেমনই অবৈধ কাজকর্মের আখড়া। আবর্জনা পরিষ্কারের পরিষেবাতেও এ শহর অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
আরও একটা জিনিস হারিয়ে গিয়েছে। তা হল, বাজারে ঝোলানো মাংসে গোল বেগুনি ছাপ। ফুড ইনস্পেক্টর খাবারের মান যাচাই করে সেই ছাপ দিলে নিশ্চিন্তে কিনতে পারতাম। এখন কিনতে হয়, সবটা ভাগ্যের উপরে ছেড়ে। রাস্তায় বিক্রি হওয়া খাবার, বাজারের বিক্রি হওয়া জিনিসে সরকারের তেমন লাগাম নেই বলেই মনে হয়। এই লাগামছাড়া দিকগুলো নিয়ে এখনই ভাবুক সরকার।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। আগে কালো ঢাউস ফোনে রিং ঘুরিয়ে যত দিন লাগত পরিষেবা পেতে, এখন হাতের চেটোয় ফোন নিয়ে তার বেশি সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বছর সাতেক আগে যে উদ্দীপনায় পরিষেবা দেওয়া হত, তা এখন প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। তবে কি উদ্যমেই ভাটা পড়েছে?