যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
‘ইন্ট্রো’ পর্ব। আক্ষরিক অর্থেই হস্টেলে নিজের পরিচয় দেওয়ার প্রক্রিয়া। অথচ, আপাতনিরীহ এই বিষয়টিই যেন এখন যাদবপুর মেন হস্টেলের আবাসিকদের কাছে আতঙ্কের অপর নাম। এই পরিচয়-পর্ব নিয়ে নানা সময়ে কানাঘুষো অভিযোগ শোনা গিয়েছে। বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে ওই পরিচয়-পর্ব নিয়ে সরব প্রতিবাদ করছেন পড়ুয়াদের একাংশ। সমাজমাধ্যমেও এই পর্বের বিবরণ লিখেছেন অনেক পড়ুয়া।
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সায়ন সেনগুপ্ত ‘ইন্ট্রো’ নিয়ে সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘প্রতিদিন রাত এগারোটা বা বারোটার পরে অত্যন্ত স্বল্প বসনে বিল্ডিংয়ের একটি করে দরজায় নক করতে হবে আমাকে। সেই ঘরের সিনিয়রেরা দরজা খুললে সাবধান পজ়িশনে দাঁড়িয়ে একটি বয়ান মুখস্থ বলতে হবে আমাকে। আমার নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম দিয়ে। তার পরে জন্মদিবস। তার পরে ‘আনুমানিক প্রতিষ্ঠা দিবস’ (আমার জন্মের সময়ের ন’মাস দশ দিন আগের দিনটি হল এই দিনটি। আশা করি, সবাই ইঙ্গিতটি বুঝতে পারছেন)। তার পরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গোটা সিভি। এই বয়ান শেষ হবে শারীরিক বর্ণনায়।’ সায়ন আরও লিখেছেন, ‘গোটা বক্তব্যে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে হয় ওঠবস, নয়তো খিলের আঘাত সহ্য করতে হবে হাঁটুর পিছনে। এই ইন্ট্রো চলবে রাত আড়াইটে পর্যন্ত।’
সায়নের লেখা থেকে স্পষ্ট যে, এই পরিচয়-পর্ব শালীনতার সীমাও ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি, সিনিয়রদের ফাইফরমাশ খাটা, দাদাদের নির্দেশে চুল ছোট করে ছাঁটতে বাধ্য হওয়ার বৃত্তান্তও জানিয়েছেন সায়ন। একই কথা জানিয়েছেন গত সপ্তাহে তিন রাত মেন হস্টেলে থাকার পরে হস্টেল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া ভূতত্ত্ববিদ্যার প্রথম বর্ষের ছাত্র অর্পণ মাজিও।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ কুণ্ডুর বক্তব্য, ইন্ট্রো আর নবীনবরণ এক ব্যাপার নয়। নবীনবরণ আনুষ্ঠানিক ভাবে হয়। পারস্পরিক পরিচয় জ্ঞাপনের এই রীতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তাতে অনেক মজার বিষয় থাকে। অনেক সময়ে মুখচোরা অল্প বয়সিরাও নিজেদের মেলে ধরতে পারেন ওই
অনুষ্ঠানে। কিন্তু, কিছু কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইন্ট্রো হল ঐতিহাসিক ভাবেই সিনিয়রদের দাদাগিরি ফলানোর পর্ব। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অত্যাচারিত পরবর্তী কালে আগ্রাসী হয়ে ওঠেন। চূড়ান্ত অবদমন থেকেই ওই বয়সে অনেকে বিকৃত আচরণের বাহক হয়ে ওঠেন। অভিজিতের ব্যাখ্যা, যাঁরা এ রকম র্যাগিং করেন, তাঁরা আদতে খুব ভিতু প্রকৃতির। তাঁরা জানেন, ক্যাম্পাসের সুরক্ষিত পরিবেশে কেউ তাঁদের কিছু করতে পারবেন না। এর বিরুদ্ধে এখনই কর্তৃপক্ষের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদারের বক্তব্য, আসলে এটা শাসক-শোষিতের এক রূপ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, র্যাগিং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তাতে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, তৈরি হয় হীনম্মন্যতা। এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার। গুরুতর হতাশা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে পারেন কেউ। অনেকে অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তির দিকেও চলে যান।
জ্যোতির্ময় বলেন, ‘‘দুনিয়া জুড়ে ক্যাম্পাসের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। ক্যাম্পাসের সকলেরই মানসিক স্বাস্থ্য সতেজ রাখায় নজর দিতে হবে। নেতিবাচক মনোভাব কারও মধ্যে না ঢোকার বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার।’’